logo
আপডেট : ২৯ জানুয়ারি, ২০২২ ১৪:৩৪
রাজনীতিতে সেলফি
এম সাইফুল ইসলাম

রাজনীতিতে সেলফি

নিজস্বী বা ‘সেলফি’ হলো আত্ম-প্রতিকৃতি আলোকচিত্র বা দল আলোকচিত্র। যা সাধারণত হাতে ধরা ডিজিটাল ক্যামেরা বা ক্যামেরা ফোন ব্যবহার করে তোলা হয়। বিশেষ করে ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ক্রমেই সেলফি ব্যবহার বেড়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সেলফি’ ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মস‚চিতে সেলফিবাজি করে নিজেকে ‘ত্যাগী’ প্রমাণ করে অনেকে পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন। আবার নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাতের সেলফি তুলে নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দলের নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অনেকে। এটিকে পুঁজি করে কেউ কেউ নেমেছেন প্রতারণায়।


বহিষ্কৃত মহিলা লীগ নেত্রী পাপিয়া, রিজেন্টের শাহেদ করিম, হেলেনা জাহাঙ্গীর ও দর্জি মনিরসহ অনেকের সেলফিবাজির প্রতারণা এখন সবার জানা। তাই রাজনৈতিক দলের অনেক নেতাই এখন এই ব্যাপারে সতর্ক।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সেলফি শব্দটি প্রথম এসেছে ইংরেজি সেলফিশ থেকে। সেলফি প্রায়ই ফেসবুক, গুগল, ইন্সটাগ্রাম, টাম্বলার এবং টুইটারে ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে শেয়ার করা হয়ে থাকে। ১৯০০ সালে পোর্টেবল কোডাক ব্রাউনি বক্স ক্যামেরা বাজারে আসার পর ফোটোগ্রাফিক আত্ম-প্রতিকৃতি তোলা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বহনে সহজ এই ক্যামেরার সাহায্যে আয়নার মাধ্যমে সেলফি তোলার প্রচলন শুরু হয় তখন থকেই।


সেলফি শব্দটির প্রাথমিক ব্যবহার ২০০২-এর আগে পাওয়া গেলেও একই বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়ান এক অনলাইন ফোরাম এবিসি অনলাইনে প্রথম ব্যবহৃত হয়। ফেসবুক জনপ্রিয় হওয়ার পর থেকে ক্রমেই সেলফি ব্যবহার বাড়তে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় তরুণদের মধ্যে সেলফি অধিক জনপ্রিয়তা পেলেও বর্তমানে এটি সমাজের সব স্তরে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ২০১২ সালের শেষের দিকে টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে ‘সেলফি’ শব্দটি বছরের আলোচিত সেরা ১০ শব্দের অন্যতম শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্বব্যাপী সেলফির ব্যবহারও বৃদ্ধি পায়।


তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেলফির নেতিবাচক প্রভাব উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নুর পাপিয়া ওরফে পিউ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। রাজনীতির অন্তরালে অস্ত্র, মাদক ও দেহ ব্যবসায় জড়িত থাকার দায়ে ওইসময় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সেলফি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিয়ে তিনি প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছিল। অবৈধ কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে কোথাও প্রতিবন্ধকতায় পড়লে তিনি প্রভাবশালীদের সঙ্গে তোলা সেলফিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন।


২০২০ সালের ১৫ জুলাই করোনা টেস্টে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক বহুল আলোচিত শাহেদ করিম। সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর এলাকা দিয়ে ভারতে পালানোর চেষ্টাকালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভয়ানক প্রতারক শাহেদেরও প্রতারণার হাতিয়ার ছিল সেলফি। তাকে চেনেন না এমন অনেকের সঙ্গে কৌশলে সেলফি তুলে তিনি নাম ভাঙিয়ে প্রতারণার ফাঁদ ফেলতেন। তার প্রতারণায় অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সেলফি তুলে তিনি প্রতিনিয়ত তা ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন।


গত বছরের ৩০ জুলাই র‌্যাবের অভিযানে আটক হন আওয়ামী লীগের উপকমিটি থেকে বহিষ্কৃৃত আরেক বহুল আলোচিত হেলেনা জাহাঙ্গীর। তাকে গ্রেপ্তারের পর সেলফিবাজির বিষয়টি আরো সামনে আসে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সেলফি তুলে ব্যাপকভাবে তা ছড়িয়ে দিতেন তিনি। সেলফিবাজি করে তিনি রাজনৈতিক দলে পদ-পদবিও কব্জাবন্দি করেছিলেন। এর কয়েকদিন পর ৩ আগস্ট কেরানীগঞ্জের ভুঁইফোঁড় নেতা দর্জি মনিরকে আটক করা হয়। অনুমোদনহীন একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন তৈরি করে ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে সেলফি তুলেই তিনি এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।


২০২১ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হন সুনামগঞ্জের ভন্ডপীর আবদুল মোতালেব। তিনি সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে সেলফি তুলে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করতেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে নিজেকে ক্ষমতাশালী হিসেবে হাজির করতেন সোহেল হোসেন রানা নামের এক ব্যক্তি। রাজধানীর গোড়ানের বাসিন্দা রানাকে গত বছরের ২৫ মে আটক করে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ইউনিটের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।


এছাড়া দলে নিজের প্রভাব দেখাতে গিয়ে অনেক সময় দেখা গেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী কর্মস‚চিতে আগেভাগে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য অবস্থান নিয়ে সেলফি তুলে তা দলীয় নেতাদের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলে অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে এই প্রবণতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে তাই এই দলটির নেতাদের সঙ্গে সেলফি তুলে তা ছড়িয়ে দিয়ে যেমন প্রভাব তৈরি করেন অনেকে। ওইসব সেলফি দেখিয়ে অনেকে চাকরিপ্রত্যাশী থেকে শুরু করে নানা কাজের কথা বলে প্রতারণা করে থাকেন।

 

আবার বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতা না থাকায় প্রতিক‚ল পরিবেশে কর্মসূচি পালনে ঝামেলা এড়াতে এই দলটির অনেক নেতা নামমাত্র কর্মস‚চিতে অংশ নিয়ে সেলফি তুলে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন বলে জানা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী সেলফিবাজির কাছে হার মানছেন। সঠিক জায়গায় স্থান পাচ্ছেন না তারা। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা হয় দৈনিক ভোরের আকাশের সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে তারা সরাসরি নাম প্রকাশ না করে বলছেন, দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের আদর্শ লালন করে থাকেন অনেকেই।

তাই পথপ্রদর্শক হিসেবে অগ্রজদের সঙ্গে ছবি তুলে তা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন অনেকে। ভালোবাসা থেকেই তারা এটি করে থাকেন। এই বিষয়টিকে যদি কেউ অন্যভাবে নিয়ে ফায়দা নেন সেটা অবশ্যই দুঃখজনক।
রাজনীতিতে সেলফির প্রভাব সম্পর্কে আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল বলেছেন- আমরা দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করি। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ আমাদের কাছে আসেন। অনেকেই ছবি তোলেন। যদি সেটি খারাপ উদ্দেশ্য তোলেন তবে সেটি দুঃখজনক। কয়েকটি ঘটনার পর থেকে সতর্ক হয়েছি।


আর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন- প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী সেলফিবাজি করতে যান না। যারা সেলফিবাজি করে পদ পদবি পেতে চান তাদের দ্বারা অন্য কিছু হলেও রাজনীতি হয় না। তবে বিভিন্ন সময়ের কিছু উদাহরণ তুলে ধরলে তিনি বলেন, সবসময় কিছু লোক ধান্দাবাজি করে থাকেন। তবে তার দল বিএনপি এ ধরণের লোক আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না।