logo
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ১৫:১৪
গান্ধীর হত্যাকারী গডসেকে নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে

গান্ধীর হত্যাকারী গডসেকে নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে

গান্ধীর হত্যাকারী গডসে

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি এক সন্ধ্যায় রাজধানী দিল্লির একটি প্রার্থনা সভা শেষ করে আসার সময় নাথুরাম বিনায়ক গডসে ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন।

৩৮ বছর বয়সী গডসে একজন ধর্মীয় উগ্র ডানপন্থি দল হিন্দু মহাসভার সদস্য ছিলেন। দলটি গান্ধীর বিরুদ্ধে খুব বেশি মুসলিম প্রীতি এবং পাকিস্তানের প্রতি উদার হয়ে হিন্দুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ করে আসছিল।

এই দলের সদস্যরা ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে আলাদা হয়ে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় সংঘটিত রক্তপাতের জন্য গান্ধীকে দায়ী করে আসছিলেন।

গান্ধীকে হত্যার এক বছর পর একটি বিচারিক আদালত গডসেকে মৃত্যুদণ্ড দেন। হাইকোর্টে রায় বহাল রাখার পর ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাসে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

গান্ধীকে হত্যার ঘটনায় গডসের সহযোগী নারায়ণ আপ্তেকেও মৃত্যুদণ্ড ও অন্য ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।

 

 

গডসে ধর্মীয় উগ্র ডানপন্থি দল হিন্দু মহাসভায় যোগদানের আগে রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘ বা আরএসএসের সদস্য ছিলেন। এই আরএসএস হচ্ছে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আদর্শিক সংগঠন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেও ৯৫ বছর বয়সী এই রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবক সংঘের দীর্ঘদিনের সদস্য। আরএসএস মোদি সরকারের বিভিন্ন নীতি নির্ধারণী বিষয়ে ভেতরে ও বাইরে থেকে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলছে।

দশকের পর দশক ধরে আরএসএস ভারতের ‘জাতির পিতার’ হত্যাকারী গডসেকে তাদের ভালোবাসার সর্বশ্রেষ্ঠ আইকন হিসেবে অভিহিত করে আসছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিন্দু ডানপন্থিদের একটি দল গডসেকে বিশিষ্ট ব্যক্তির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে এবং প্রকাশ্যে গান্ধীর এই হত্যাকাণ্ড উদযাপন করছে।

গত বছর বিজেপির এক সংসদ সদস্য গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলে অভিহিত করেন। গডসেকে নিয়ে এসব কথাবার্তা বেশিরভাগ ভারতীয়কে ক্ষুব্ধ করলেও আরএসএস তাদের অবস্থানে অটল রয়েছে। আরএসএস যদিও দাবি করে যে, গান্ধীকে হত্যার অনেক আগেই গডসে তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক বইয়ে দাবি করা হচ্ছে, গডসেকে নিয়ে প্রচলিত এই কথাগুলো যেভাবে বলা হচ্ছে আসলে তা এমন নয়। গডসে ছিলেন একজন হাইস্কুল ড্রপআউট।

তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগদানের আগে দর্জির কাজ করতেন এবং ফলমূল বিক্রি করতেন। তিনি মহাসভা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র সম্পাদনা করতেন। তবে বিচার চলাকালে গডসে ১৫০ অনুচ্ছেদের একটি জবানবন্দি পড়তে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়েছিলেন।

মামলার বিচার চলার সময় গডসে দাবি করেন, গান্ধীকে হত্যার পেছনে ‘কোনো ষড়যন্ত্র’ ছিল না। তিনি এই কথা বলে মূলত এই হত্যাকাণ্ডে তার সহযোগীদের দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

গান্ধীকে হত্যার পেছনে তার নেতা হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের নির্দেশ আছে বলে অভিযোগ আছে। গডসে এই অভিযোগ আদালতে অস্বীকার করেছিলেন।

আদালত বিনায়ক দামোদর সাভারকারকে গান্ধী হত্যাকাণ্ডের সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন। তবে সমালোচকরা মনে করেন, উগ্র ডানপন্থি বিনায়ক দামোদর সাভারকার গান্ধীকে তীব্রভাবে ঘৃণা করেছিলেন এবং গান্ধী হত্যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

বিচার চলাকালে গডসে আদালতকে জানিয়েছেন, গান্ধীকে হত্যা করার অনেক আগেই তিনি আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।

গান্ধীর হত্যাকারীর ওপর এই বইয়ে লেখক ধীরেন্দ্র ঝা লিখেছেন, গডসে ছিলেন এক ডাক বিভাগের কর্মীর ছেলে এবং তার মা ছিলেন গৃহিণী। গডসে ছিলেন আরএসএসের একজন ‘নিবেদিত প্রাণ কর্মী’ এবং তাকে এই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করার কোনো ‘প্রমাণ’ এখন পর্যন্ত নেই।

বিচার শুরুর আগে রেকর্ড করা গডসের এক জবানবন্দিতে কখনোই দাবি করা হয়নি যে, ‘গডসে হিন্দু মহাসভার সদস্য হওয়ার আগে আরএসএসসের সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন’। যদিও আদালতের জবানবন্দিতে গডসে বলেছিলেন তিনি ‘আরএসএস ত্যাগ করার পরে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক কখন আরএসএসের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছেন তা নিয়ে গডসে নীরব ছিলেন।

ঝা বলেন, ‘আরএসএস ত্যাগ করার পরে গডসে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছিলেন- এ দাবি তার জীবনের অন্যতম বিতর্কের বিষয় হয়ে আছে’। ঝা মনে করেন, ‘আরএসএসপন্থি লেখকরা’ একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে ‘গডসে গান্ধীকে হত্যা করার প্রায় এক দশক আগে আরএসএসের সঙ্গ ছেড়ে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছিলেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক জা কুরান জুনিয়র দাবি করেছেন, গডসে ১৯৩০ সালে আরএসএসে যোগ দিয়েছিলেন এবং চার বছর পর এই দল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি যদিও এই দাবির স্বপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

অন্যদিকে ঝা লিখেছেন, তার বিচার শুরু হওয়ার আগে পুলিশের কাছে দেওয়া একটি জবানবন্দিতে গডসে স্বীকার করেছেন যে, তিনি একই সময়ে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএসের হয়ে কাজ করছিলেন।

নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে, যিনি ২০০৫ সালে মারা গেছেন, তিনি বলেছিলেন, তার ভাই কখনোই ‘আরএসএেসর সঙ্গ ত্যাগ করেননি’।

গডসের এক ভ্রাতুষ্পুত্র ২০১৫ সালে এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘গডসে ১৯৩২ সালে আরএসএসে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাকে কেউ বহিষ্কার করেনি এবং তিনিও আরএসএস ত্যাগ করেননি’।

আরএসএস এখন গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ইস্যুতে আদালতে গডসে যা বলেছিলেন তা বলে বেড়ায়। বলে, তিনি ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সংগঠনটি ছেড়েছিলেন এবং আদালতের রায় প্রমাণ করে, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরএসএসের কোনো সম্পর্ক নেই।

সিনিয়র আরএসএস নেতা রাম মাধব বলেন, ‘গডসে যে আরএসএস সদস্য ছিলেন তা বলা হয় শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য’।

আরএসএসের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এম এস গোলওয়ালকার গান্ধীর হত্যাকাণ্ডকে ‘অতুলনীয় মাত্রার ট্র্যাজেডি’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এই হত্যাকারী একজন ভারতীয় এবং হিন্দু’।

সম্প্রতি আরএসএস নেতা এম জি বৈদ্য গডসেকে ‘খুনি’ বলে অভিহিত করেছেন। বৈদ্য বলেন, গডসে গান্ধীর মতো একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে হত্যা করে হিন্দুত্ববাদকে ‘ছোট করেছেন’।

সূত্র: বিবিসি।