logo
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ১১:৩২
বেগমপাড়ার তথ্য কার কাছে?
জুনায়েদ হোসাইন

বেগমপাড়ার তথ্য কার কাছে?

* পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তালিকা চেয়েও পাচ্ছে না দুদক * কানাডা-মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে গড়ে উঠছে সেকেন্ড হোম * বেশির ভাগই পাচার করা অর্থ * রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীরাই জড়িত * বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন স্ত্রী-সন্তান।

জীবিকার খোঁজে প্রতিদিন দেশ থেকে বিদেশ যাচ্ছেন অনেকে। আবার অবৈধভাবে দালাল ধরে ঝুঁকি নিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা পাড়ি দিচ্ছেন ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে। এতে পথেই মৃত্যু হয় অনেকের। কেউবা লাশ হয়ে দেশে ফিরেন। সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ঠান্ডায় জমে সাতজন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এমন ঘটনা প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে।

প্রবাশীরা বিদেশে কষ্টের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন পরিবারের সুখ-শান্তির জন্য। অন্যদিকে এক শ্রেণির উচ্চাভিলাষী দুর্নীতিবাজ রয়েছেন, যারা দেশ থেকে বিদেশে কারি কারি টাকা পাঠাচ্ছেন, সেখানে বসবাস করা তাদের বেগম ও সন্তানদের জন্য। এমন একটি অঞ্চলের সন্ধান পাওয়া গেছে কানাডায়। যেখানে বাংলাদেশের উঁ”ু শ্রেণির পরিবারের লোকদের বসবাস। সেখানকার বিলাসী বাড়িগুলোতে থাকেন স্ত্রী-সন্তান, আর স্বামী থাকেন দেশে। মূলত এ কারণেই এ পাড়ার নামকরণ হয়েছে ‘বেগমপাড়া’।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে রাজননৈতিক অঙ্গনজুড়ে এ পাড়া নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা। কৌতূহল আছে, প্রকৃত অর্থে এসব বাড়ির মালিক কারা। কারাইবা গড়ে তুলেছেন এই বেগমপাড়া? বিপুল অর্থ বিণিয়োগ করে সেখানে কেনা হয়েছে বাড়ি বা ফ্ল্যাট। ধারণা করা হয়, অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ পাচার করেই সৃষ্টি হয়েছে বেগমপাড়ার। অথচ সরকারের খাতায় সেই দুর্নীতিবাজদের কোনো তথ্য নেই।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাইকোর্টের নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার বেগমপাড়ার মালিকদের তথ্য চাইলেও দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বেগমপাড়ায় অঢেল অর্থের বিনিময়ে বিলাসবহুল শান-শওকত যারা গড়ে তুলেছেন, তাদের বেশির ভাগই রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও ব্যবসায়ী। বাণিজ্যসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এসব টাকা মানিলন্ডারিং করছেন তারা।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় বছরে দেশ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা বা ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। এই হিসাবে গড়ে প্রতি বছর পাচার হচ্ছে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা।

ধারণা করা হচ্ছে, এসব টাকায় পাচারকারীরা বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ে তুলেছেন। কানাডার টরেন্টোতে অতি যতেœ গড়ে তোলা এলাকার নামই ‘বেগমপাড়া’। শুধু কানাডা বলে কথা নয়, অন্য দেশেও এমন বেগমপাড়ার খোঁজ পাওয়া গেছে।

আমলা, রজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা কানাডা, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা তাদের বেগমদের জন্য বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বা বিনিয়োগকারী হিসেবে নাগরিকত্ব¡ কিনে থাকেন।

বিশ্লেষক বলেছেন, বিদেশে অবস্থান করা বাংলাদেশি বেগমদের আরাম-আয়েশ দেখলে মোগল বেগমরাও হিংসায় জ্বলতেন। তাদের অ্যাপার্টমেন্টগুলো বিলাসসামগ্রীতে ভরা। সন্তানেরা সেসব দেশের নামিদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে। বেগমদের একমাত্র কাজ হলো ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করা আর আরাম-আয়েশ করা।

বিষয়টি উচ্চ আদালত, প্রশাসন এবং দুদকের নজরে এলে বারবার চেষ্টা করেও বেগমপাড়ার সাহেবদের তালিকা জোগাড় করা যাচ্ছে না। তবে আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নামও উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে দুদকের বর্তমান চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন আবদুল্লাহ সম্প্রতি তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, কানাডার বেগমপাড়ায় কাদের বাড়ি রয়েছে, এ বিষয়ে বারবার তালিকা চেয়েও পাচ্ছি না। যিনি এ কথা বলেছিলেন, তার কাছ থেকে তালিকা চেয়েও পাচ্ছি না, আমরা কীভাবে এগিয়ে যাব? তালিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে তো আমাদের কোনো ম্যাকানিজম নেই। আমরা তালিকা পেলে অবশ্যই দেখব। যতটুকু পেয়েছি, তা নিয়ে কাজ করছি।

তবে কতটুকু তালিকা দুদক পেয়েছে তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে তা প্রকাশ করতে রাজি নয় এই সংস্থাটি। অবশ্য বছরখানেক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছিলেন, কানাডায় টাকা পাচার করে বাড়িঘর বানিয়েছে এ রকম ২৮টি ঘটনা আছে। তবে এর মধ্যে রাজনীতিবিদ মাত্র চারজন। বাকিরা সরকারি কর্মচারী ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ী।

উল্লেখ্য, তালিকা চেয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রথম দফায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় দুদক। পরবর্তী সময়ে তালিকা চেয়ে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবারও চিঠি দেয় দুদক।

মানিলন্ডারিং বা টাকা পাচারকারীদের তালিকা প্রাপ্তির বিষয়ে সচেতন মহল বলছেন, বিদেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের কূনৈতিকরা সেই দেশের বাংলাদেশি কমিউনিটির তথ্য জানার কথা। সেখানকার বাংলাদেশি নাগরিকরা কে কি করছেন, কার কি পেশা? সেই তথ্যও অ্যাম্বাসির কাছে থাকার কথা।

অনেকে বলছেন, প্রথমত, তারা বাংলাদেশি, পরে না হয় নাগরিকত্ব¡ লাভ করেন। এই যে প্রক্রিয়াটা তা’ কাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ছাড়া সম্ভব নয়। তবে ইচ্ছা থাকলে উপায় মিলবে বলেও মনে করেন বিশ্লেকরা।

এদিকে হাইকোর্টের নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দেওয়া চিঠিতে দুদক লিখেছে, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ও পত্রিকায় প্রকাশিত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মিস-ইনভয়েসিং, হুন্ডি, ব্যাংক ক্যাশ ট্রান্সফার ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়।

ফলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত তার মূলধন হারানোর ফলে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের একাংশ এ দেশ থেকে অর্থ পাচার করে বিদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন।

বহুল আলোচিত পানামা পেপার্স, প্যারাডাইস পেপার্স ইত্যাদি কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন বাংলাদেশি নাগরিকের নামও উঠে এসেছে। এই ধারা রোধ করা সম্ভব না হলে আমাদের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ভবিষ্যতে থমকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশি নাগরিকদের বিদেশে অর্থ পাচারের মাধ্যমে নাগরিকত্ব গ্রহণ রোধের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। এতে একদিকে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে দেশীয় সম্পদ ফেরত আনার পাশাপাশি অন্যদের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে, যা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করবে।

দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নতুন কমিশন গঠনের পর থেকেই দুদকের মামলার তদন্ত ও প্রসিকিউশনের গুণগতমান নিশ্চিতকরণের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। কমিশন দাবি করছে, এখন পর্যন্ত কমিশন কর্তৃক করা মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলায় প্রায় শতভাগ সাজা হয়েছে। এটি গত কয়েক বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসাকে দুদকের জন্য গর্বের বলে মনে করা হচ্ছে। দুদক বিশ্বাস করে, মানিলন্ডারিং মামলায় নিখুঁত তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে তা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারায় এ সাফল্য এসেছে।

মানিলন্ডারিং ও বেগমপাড়া বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যন গোলাম রহমানের মতামত জানতে চাইলে তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, আমি অনেক আগে দুদকের চেয়ারম্যান ছিলাম। তখন যেভাবে দরকার সেভাবে চেষ্টা করেছি। আমার পরবর্তী যারা এসেছেন, তারাও চেষ্টা করছেন। বর্তমানে যারা আছেন, তারাও ভালো করবেন এটাই আশা। এর বাহিওে কিছু বলতে পারছি না। সব বিষয়ে খেয়াল রাখতে পারছি না।

গত ২৭ জানুয়ারি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির ‘ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১ : উদ্যোক্তা মতামত’ শীর্ষক জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, আগামী দুই বছর টাকা পাচার বেড়ে যেতে পারে। এর কারণ হিসেবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখছেন তারা।