‘হৃদির কোনো দোষ নেই। সব ভুল আমার। ভুলগুলো আমারই। ভুলের খেসারত দিতে দিতে অসহ্য হয়ে গেছি। আর পারছিলাম না কিছুতেই। পৃথিবীটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। ভুলের বোধ হয় ক্ষমা হয় না। এত অপরাধী হয়েছি যে, প্রিয় মানুষটিও বুঝতে পারছিল না আমাকে। আমার আর ভালো লাগছিল না। একবিন্দুও বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝতে পেরেছি, এ পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। আমি তাই চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো প্রিয় হৃদি। শুভকামনা সবার জন্য। বিদায়।’
এটি একটি সুইসাইড নোট। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার পূর্বে জীবনের কাছে পরাজিত এক প্রেমিকের লেখা। ভোলার এক কলেজছাত্রের লাশের পাশে জব্দ করা হয়েছিল এটি।
এভাবেই ঝরছে যুব-প্রাণ। সম্ভাবনার জীবনগুলো বিদায় নিচ্ছে। মানুষ তো স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে। সুন্দর পৃথিবীতে মানুষ বাঁচতে চায়। তারপরও ঘটে অনভিপ্রেত ঘটনা। অকালেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মানুষ। হতাশা থেকেই জীবন থেকে মুক্তি চায়। পরাজিতের মতোই অবলম্বন করে অপ্রত্যাশিত এ পথ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে যখন মানুষ সচেতন হচ্ছে, ঠিক তখন বেশিরভাগ আত্মহত্যার নেপথ্যের কারণ হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে প্রেমে ব্যর্থতা। সম্পর্কের অবনতি। প্রতি মাসে দেশে সহস্রাধিক মানুষ আত্মহত্যা করছে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, বছরে এ সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি। এর বেশিরভাগই যুব। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
সম্প্রতি পপি নামে এক তরুণী আত্মহত্যার পূর্বে চিরকুটে লিখেছেন, ‘মোনায়েম তুমি ভালো থেকো। সরল মনে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। কিন্তু তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারলে না। আমি আমার এ কলঙ্কিত মুখ নিয়ে আর বেঁচে থাকতে চাই না। তোমাকে সরল মনে ভালোবেসে কী অপরাধ করেছিলাম, জানি না। তুমি ভালো থেকো। আমি তো তোমার কাছে আগে যাইনি, তুমিই তো আমাকে আগে ভালোবেসেছো। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, এটা তোমার অভিনয়। তবুও সুখে থেকো। সারাটা জীবন অনেক ভালো থেকো, এটাই চাই।’
চিরকুটের শেষে রয়েছে আরো আক্ষেপ। প্রতিটি শব্দ জানান দিচ্ছিল, মেয়েটি বাঁচতে চেয়েছিল।
পপি লিখেছেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে কেন এমন করলে। কী ক্ষতি করেছিলাম তোমার? আমি মনপ্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। তুমি শুধু আমার দেহটাই বেছে নিয়েছিলে। আমি তো তোমায় সরল মনে ভালোবেসেছিলাম।’ পপি নামের এ কলেজছাত্রী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের বাসিন্দা।
সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক সাজ্জাদ ইফাত ভোরের আকাশকে জানান, বছরে দেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। তাদের মধ্যে ৫৭ শতাংশই নারী। তবে গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আত্মহত্যার হার বেড়েছে।
আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, এর মধ্যে ২৫ শতাংশের মৃত্যুর নেপথ্যে প্রেমের সম্পর্কের অবনতি। গত বছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে ৬৫ জনই ছাত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহত্যা করেছে ২৪.৭৫ শতাংশ। পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ। লেখাপড়া সংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ এবং আর্থিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করছেন ৪.৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে ১১ হাজার ২৫৯ জন আত্মহত্যা করেন। এর আগে ২০১৯ সালে ৯ হাজার ৩১০ জন আত্মহত্যা করেন। সরকারের হিসাবে করোনাকালে ১৭.৩১ শতাংশ আত্মহত্যার ঘটনা বেড়েছে।
গবেষকদের মতে, মানসিক হতাশা থেকেই এ অনাকাক্সিক্ষত পথ বেছে নেন আত্মহত্যাকারীরা। এ হতাশা অন্যদের কাছে ঠুনকো মনে হলেও আত্মহত্যাকারীদের কাছে অনেক বড় এবং অসহ্য। ফোন ব্যবহার নিয়ে বকাঝকা করায় মা-বাবার সঙ্গে অভিমান করে ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। খাবার, কাজ নিয়ে কটু কথা বলার কারণেও অনেকে জীবন দিচ্ছেন।
আবার পারিবারিক অশান্তির কারণেও নিজের জীবনের সমাপ্তি টেনে মুক্তি চাচ্ছেন অনেকে। এমনই একজন হচ্ছেন দিনাজপুরের রামনগরের খানসামার জুঁই রায়।
২২ বছর বয়সি এ গৃহবধূ গত ১১ জানুয়ারি আত্মহত্যা করেন। তার আগে তিনি চিরকুটে স্বামীর উদ্দেশে লেখেন, ‘মুই মরি গেইলে আরো বিয়াও করিস, সুখে থাকিস, ভালো থাকিস। তোর জীবনে মুই আর কাঁটা হয়া থাকিবার চাই না। মোর আর কোনো ইচ্ছা নাই। তোর জীবন থাকি মুই যদি চলি যাই, তাহলে তোর পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করিস। তোর কাছে তো মোর কোনো দাম নাই। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকিস। সবার চোখের কাঁটা হচ্ছি, তাই মোর বাঁচি থাকার কোনো ইচ্ছা নাই। সবাই সুখে থাকো, ভালো থাকো।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা সন্তানদের বড় বড় ডিগ্রি দিচ্ছি, কিন্তু যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিল করার জ্ঞান, মানসিকতা দিতে পারছি না। সম্পর্কের ব্যর্থতা নতুন নয়।
কিন্তু এ কারণে বেশিরভাগ আত্মহত্যা ঘটছে। আবেগ দমন করতে পারছে না। আবেগের অপরিপক্বতার কারণে এমনটি হচ্ছে। এর দায় শিক্ষা ব্যবস্থার। অবশ্য এক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও সামাজিক সংগঠনকেও ভূমিকা রাখতে হবে। এজন্য খেলাধুলা করা প্রয়োজন। খেলতে গিয়ে পরাজিত হলে ব্যর্থতা সহ্য করার শক্তি তৈরি হয়, যা অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজে লাগে।
তিনি বলেন, আত্মহত্যা করার মানসিকতা একদিনে তৈরি হয় না। যারা আত্মহত্যা করেন, তারা ধীরে ধীরে এ পথে ধাবিত হন। তাই সহানুভূতি, ভালোবাসা দিয়ে তাদের ফেরানো সম্ভব। এজন্য তার সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রয়োজন; বিশেষ করে পরিবারের সদস্যদের। তাদের দায়িত্ব মনস্তাত্ত্বিক সমর্থন দেওয়া, কাউন্সেলিং করা। এতে এ অনাকাক্সিক্ষত পথ থেকে অনেককেই ফেরানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।