logo
আপডেট : ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ১৩:২২
বাঘের মুখ থেকে মানুষ ফিরিয়ে আনেন ‘টাইগার গণি’
আহসান রাজিব, সাতক্ষীরা

বাঘের মুখ থেকে মানুষ ফিরিয়ে আনেন ‘টাইগার গণি’

বাঘের পাশে টাইগার গণি

হিংস্রতার প্রতীক বাঘ। প্রাণিটির শরীরের বিকট গন্ধ ও গর্জনে যে কারো বুক কাঁপতে পারে। আমাদের দেশের সুন্দরবনে শুধু দেখা মেলে হিংস্র এই প্রাণিটির। একে দেখতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভে ভিড় করেন পর্যটকরা।

মুখে খুব সহজে এই প্রাণির নাম বলা গেলেও কেউ চান না বাঘের সামনে পড়তে। সেই বাঘের মুখ থেকে মানুষকে ছিনিয়ে আনেন আব্দুল গণি গাজী। যিনি সবার কাছে ‘টাইগার গণি’ নামে পরিচিত।

সুন্দরবন সংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজাননগর ইউনিয়নের কালিঞ্চি গ্রামে বাস গণির। এখন বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। অভাবে পড়ালেখা করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে ছোট বয়সেই বাবা বদরউদ্দীন গাজীর সঙ্গে সুন্দরবনের নদী খালে মাছ শিকার করতেন। সুন্দরবন এবং এর সংলগ্ন নদী ঘুরে ঘুরে জেলে আব্দুল গণি গাজী এখন পরিচিতি পেয়েছেন ‘টাইগার গণি’ নামে।

সুন্দরবনে যাওয়া জেলে বাওয়ালিদের কেউ যদি বাঘের আক্রমণের শিকার হয়ে নিহত বা আহত হন তাদেরকে বাঘের কাছ থেকে উদ্ধার করে আনেন আব্দুল গণি গাজী। এ জন্যই তিনি এখন ‘টাইগার গণি’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাঘের মুখ থেকে ছিনিয়ে এনেছেন একশ’র বেশি মানুষকে। তবে টাইগার গনির এ পরিচিতি একদিনে হয়নি।

‘টাইগার গণি’ নামের বিষয়ে জানতে আব্দুল গণি গাজীর সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয় দৈনিক ভোরের আকাশের প্রতিবেদকের।

তিনি বলেন, ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে সুন্দরবনের নদী খালে মাছ ধরতে যেতাম। স্থানীয় সহযোগী হিসেবে ২০০৭ সালে বন বিভাগকে সহযোগিতা করতে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক গঠিত ওয়াইল্ড টিমে আমার কাজ করার সুযোগ হয়। ওই সময় বাঘের আক্রমণে আমার এলাকার একজন মৌয়াল প্রাণ হারান। আমি সেই মরদেহটি উদ্ধার করতে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের সহযোগিতা করি।

‘পরে আমি ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিমের টিম লিডারের দায়িত্ব পাই। এরপর টানা ১২ বছর ওয়াইল্ড টিমের সঙ্গে থেকে সুন্দরবনে কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হলে আমি তাদের উদ্ধার করে আনি। এই দীর্ঘ সময়ে আমি ৭০টিরও বেশি মরদেহ বাঘের কাছ থেকে উদ্ধার করে এনেছি। এ ছাড়া কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালে ওয়াইল্ড টিমের ফরেস্ট রেসপনস টিমের প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হলেও আমার কাজ অব্যাহত রয়েছে। যখনই খবর আসে কোনো মানুষকে বাঘে ধরেছে আমি সঙ্গে সঙ্গে বনে ছুটে যাই। সবশেষ গত ২১ ডিসেম্বর বাঘের আক্রমণে নিহত বনজীবী মুজিবর রহমানের মরদেহটিও আমি উদ্ধার করে এনেছি।’

‘২০ ডিসেম্বর বিকেলে মুজিবর রহমানকে সুন্দরবনের পায়রা টুনি খাল থেকে বাঘে ধরে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে রেসকিউ টিমের সঙ্গে আমিও বনে যাই। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর বাঘের পায়ের ছাপ ও রক্তের দাগ দেখে বনের গভীর থেকে মুজিবর রহমানের মৃতদেহটি উদ্ধার করে আনি। এই অল্প সময়ে বাঘটি মৃতদেহটির একটি পা পুরোটাই খেয়ে ফেলে।’

‘মৃতদেহটি উদ্ধার করে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছি এটুকুই আমার তৃপ্তি। আমি স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করি। এসব কাজের জন্য আমি কোনো পারিশ্রমিক নেই না’, যোগ করেন তিনি।

পরিবারের কথা জানিয়ে এই সাহসী মানুষ বলেন, ‘মা-বাবা মারা গিয়েছেন। পরিবারে আমিসহ স্ত্রী, এক ছেলে ও মানসিক ভারসাম্যহীন এক বোন রয়েছে। একটি মেয়ে ছিল তাকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। ছেলে গতবার এইচএসসি পাস করেছে। চাকরি যাবার পর মাঝে মাঝে বনে মাছ ধরতে যেতাম। ছোট একটি ব্যবসাও শুরু করেছিলাম।

‘তবে লোকসানে পড়ে বর্তমানে আমি মোটরসাইকেল ভাড়া চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। যদি কোনো সংস্থায় কাজের সুযোগ পাই আবারও কাজ করব। তবে বর্তমানে বাঘ নিয়ে সুন্দরবনে কোনো প্রজেক্ট চলছে না।’

বাঘের মুখোমুখি হয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে টাইগার গণি বলেন, ‘২০০৯ সালে ডিঙ্গিমারি নামক একটি খাল এলাকায় একজনকে বাঘে ধরে। তাকে উদ্ধার করতে সেখানে গিয়ে নিজেই বাঘের মুখে পড়ি। বাঘ ওই মানুষটাকে খেতে খেতে শুধু বুকের পাঁজর আর মাথাটুকু বাকি রেখেছিল।

‘সুন্দরবনে গাছের গায়ে থাকা রক্ত, মাংস ও বাঘে টেনে নিয়ে যাওয়ার স্পটগুলো চিহ্নিত করেই মূলত মরদেহ শনাক্তের কাজ শুরু করি। ৩-৪ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর মরদেহটির সন্ধান পাই। আমার থেকে ১০-১২ হাত দূরে ছিল মরদেহটি। হঠাৎ দোয়েল পাখির মতো কী যেন একটা সামনে দিয়ে উড়ে গেল!

‘থমকে দাঁড়ালাম। এক মিনিটের মধ্যেই বাঘ সামনে হাজির। আমার দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বাঘটি! আর কী গর্জন! বাঘের গর্জন খুব ভয়ানক হয়। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তবে সাহস হারাইনি। বাঘের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। একসময় মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করলাম, তখনো বাঘ ভয়ানক গর্জন করছিল।

‘এরপর আমি হাতে থাকা লাঠি দিয়ে শব্দ করতে থাকলাম। হঠাৎই বাঘের গর্জন থমকে গেল। দেখলাম বাঘটি চলে গেছে। মরদেহের অবশিষ্ট থাকা বুকের পাঁজর ও মাথাটা নিয়ে দ্রুত নৌকায় ফিরলাম। বাঘের মুখোমুখি হবার সেই দিনের ভয়ানক স্মৃতি আমি আজও ভুলিনি।’

উদ্ধার করতে গিয়ে ভয় লাগে কি না- এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের মধ্যে অনিশ্চিত যাত্রায় বাঘের মুখ থেকে মানুষকে উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক ঘটনা। আমারও ভয় লাগে তবে কাউকে বুঝতে দেই না। আমি টিম লিডার হয়ে যদি ভয়ে থাকি তবে বাকি সদস্যরা এই উদ্ধার কাজ করতে সাহস হারাবে।’

টাইগার গণিকে নিয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটি সাতক্ষীরার আহ্বায়ক গাজী সালাউদ্দিন বাপ্পি বলেন, ‘গণি খুব ভালো মানুষ, সুন্দরবনে কাউকে বাঘে ধরেছে শুনলেই স্বেচ্ছায় উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। স্থানীয়রা তাকে এই সাহসী কাজের জন্য শ্রদ্ধা করে। চাকরি না থাকায় বর্তমানে অর্থকষ্টে দিন কাটছে তার। এরপরও মানুষের বিপদে এগিয়ে আসেন তিনি। সরকারিভাবে এই সাহসী মানুষটিকে সম্মানিত করার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত।’

পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) কর্মকর্তা এম এ হাসান বলেন, ‘টাইগার গণি এক সময় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। তখন থেকে কেউ বাঘের আক্রমণের শিকার হলে তাকে উদ্ধার করতেন তিনি। সে সময় ওয়াইল্ড টিম ও বন বিভাগ থেকে তাকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

‘বর্তমানে আমাদের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে কয়েকদিন আগে বাঘের আক্রমণে নিহত মুজিবরকে উদ্ধার অভিযানে রেসকিউ টিমের সঙ্গে আব্দুল গণি স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছিলেন।’

তিনি আরো বলেন, সুন্দরবনে বর্তমানে ওয়াইল্ড টিমের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে ভবিষ্যতে কোনো সুযোগ হলে টাইগার গনির জন্য কাজের ব্যবস্থা করা হবে।