logo
আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০৮:২১
সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে
শাহীন রহমান

সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে

ভাষার মাস

শুরু হলো ভাষার মাস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুযারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার রাজপথে জীবন উৎসর্গ করার স্মৃতি এ মাসেই সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।ভাষার মাস এলেই বাঙালির চোখে ভেসে ওঠে স্বাধীনতা-সংগ্রামের কথা। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ‘৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের কথা। আন্দোলনের এ গতিপথ নির্ধারিত হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মাধ্যমেই ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ এবং জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ ঘটে।

এ ভাষার মাসেই পাকিস্তানি জান্তার পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে রাজপথে রক্ত দিয়েছিলেন সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক। বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয়েছিল এ মাসেই। শহীদের বুকের তাজারক্তের বিনিময়েই বাঙালি জাতি পায় মাতৃভাষার মর্যাদা। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা। তারই পথ ধরে শুরু হয় বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন। একাত্তরে ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৫২ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হলেও এর ইতিহাস ছিল অনেক পেছনে। ভারত-পাকিস্তান তখনো সৃষ্টি হয়নি। তবে বিতর্কটা শুরু হয়ে গেছে। বিতর্ক পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে। ‘বাংলা’ নাকি ‘উর্দু’- কী হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর দেশ বিভাগের পর তো কথাই নেই। এটিই ছিল পূর্ব বাংলার সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত প্রশ্ন। খুব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলার তৎকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ভাষার প্রশ্নটি ছিল অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই পশ্চিমা নেতারা এমন মনোভাব প্রকাশ করতে থাকেন- একমাত্র উর্দুই হবে নতুন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-ভারত বিভক্ত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়।
আদি বাঙালির সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক জীবন এবং ক্রমবিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বাঙালির শৌর্যবীর্য যেন ধপ করে জ্বলে ওঠে এ মাসেই। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধহাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য প্রথম বলীদান বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে। সেই থেকে শুরু হয়ে যায় বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই।

পাকিস্তানিদের সঙ্গে হিসাব-নিকাশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাঙালি শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। পলাশীর আম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া সেই সিরাজ-উদ্দৌলা আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রূপে এ লড়াইয়ে সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হন। ’৫২ সালে যে আগুন জ্বলেছিল রাজধানী ঢাকা শহরে, সে আগুন যেন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দেশের আনাচে-কানাচে সবখানে। যে আগুন জ্বলেছিল মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে সবখানে সবখানে। বাঙালির বুকের ভেতর জ্বলে ওঠা আগুন যেন সহস্র বাঙালির মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে, যা এসে শেষ হয় একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
এ ভাষার মাসেই শহীদদের স্মরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। তবে করোনা মহামারির কারণে এবারের একুশের অনুষ্ঠানমালায় আনা হচ্ছে পরিবর্তন। একুশের মাসের সবচেয়ে বড় কর্মযজ্ঞ মাসব্যাপী গ্রন্থমেলা এবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে না। ইতোমধ্যে মেলা দুইসপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। করোনা মহামারির বাস্তবতা বিবেচনা করে এবারও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলা আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের বহু আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস থাকলেও ভাষা আন্দোলন নজির কোথাও নেই। ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার ইতিহাস একমাত্র বাঙালির রয়েছে। তাই কবি লিখেছেন, ‘ফেব্রুয়ারি একুশ তারিখ/দুপুর বেলার অক্ত/বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়? বরকতের রক্ত।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব থেকে বহু জাতিগোষ্ঠীর ভাষা চিরততর হারিয়ে গেছে। এ কারণে ভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই আজ এক মর্যাদার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এক হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতি ১৪ দিনে বিশ্ব একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটছে। ইউনেস্কোর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের প্রায় ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ ভাষা বিপন্নের তালিকায় রয়েছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের ২৯টি ভাষাকেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭টি ভাষা দারুণভাবে বিপন্ন। ৪টিতে তারা নিশ্চিত বিপন্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ২টি ভাষাকে দোদুল্যমান, অর্থাৎ বিপন্ন ও নিরাপদ ভাষার মাঝামাঝি অবস্থানে দেখানো হয়েছে। আর ১৬টি ভাষার ক্ষেত্রে কোনো পরিচয়ে আবদ্ধ করা হয়নি।

ভাষা বিলুপ্ত বা বিপন্ন হওয়ার কারণ হিসেবে ভাষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফলেঅনেক স্থানীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী হত্যা বা নির্যাতনের শিকার হয়। এ কারণে ভাষার বিলুপ্তি বা বিপন্ন হয়ে পড়ে। আবার গোষ্ঠীগত আধিপত্য বা প্রধান্য বিস্তারের ফলে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার কোনো জনপদে নতুন কোনো ভাষার অভিষেক ঘটলে সেই অঞ্চলের প্রাচীন ভাষাও বিপন্ন হয়ে পড়ে। তবে ক্ষুদ্র জাগিগোষ্ঠীর ভাষাই শুধু বিপন্ন তালিকায় স্থান পেয়েছে।