logo
আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৩৮
প্রতারণার আতঙ্ক, অফিস উধাও
পঞ্চাশ বছরেও আস্থা ফেরেনি বিমায়
সুশাসনের ঘাটতি, দাবি পরিশোধে গড়িমসি
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

পঞ্চাশ বছরেও আস্থা ফেরেনি বিমায়

প্রতীকি ছবি

ডা. বারবন বিমা ১৬৬৬-৬৭ সালে বিমার ধারণা নিয়ে আসেন। ধারণা নিয়ে তিনি লন্ডনে ‘ দ্য ইন্স্যুরেন্স অফিস’ নামক ছোট একটি অফিস নিয়ে বিমার ব্যবসা শুরু করেন। সেই থেকে শুরু। বিশ্বের বুকে সুদৃঢ় অবস্থান করে নেয় বিমা ব্যবসা। ভারতীয় উপমহাদেশে বিমা ব্যবসায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ব্রিটিশ আমলে ১৮১৮ সালে। বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালে।

এরপর পেরিয়ে গেছে আরো ৫০ বছর। এখনো বিমায় আস্থা ফেরেনি। সময়ের পরিবর্তনে বদলে গেছে বিমার আইনকাকুন ও ধরন। এসেছে মানসিকতায় পরিবর্তন। এর মধ্যে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বিমা। কিন্তু পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। বিমার কথা শুনলেই আঁতকে ওঠেন জনগণ।

প্রকৃতপক্ষে বিমা আস্থার জায়গা। অনাগত দুর্ঘটনার পরিপূরক হচ্ছে বিমা। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় জটিলতার কারণে এই বিমার প্রতি মানুষের অনাস্থা। বাংলাদেশে বিমার প্রধান সমস্যা হলো পরিবারতন্ত্রও কমিশন ব্যবস্থা। বেশির ভাগ কোম্পানির পরিচালনায় রয়েছে আত্মীয়স্বজন, যার ফলে স্বচ্ছতার অভাব। দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে এজেন্টদের কমিশনবাণিজ্য।

বিমা প্রিমিয়ামের একটা অংশ চলে যায় এজেন্টের পকেটে। এতে একদিকে বিমাকারীর লাভ কমে যায়, যার ফলাবর্তন ঘটে বিমাগ্রহীতার ওপর। এদিকে নির্দিষ্ট সময় শেষে বিমা মূল্য ফিরে না পাওয়া, বিমা অফিস উধাও, বিমামূল্য হিসাব-নিকাশে শুভঙ্করের ফাঁকি ইত্যাদি কারণে বিমায় মানুষের অনাস্থা।

এদিকে প্রকাশ্যে বা বেনামে আইনবহির্ভূতভাবে একই পরিবারের সদস্যদের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার মালিকানার ঘটনাও রয়েছে। করপোরেট কাঠামোর দিক থেকেও আর্থিক খাতের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে খাতটি।

দেশে বিদ্যমান জীবনবিমা কোম্পানিগুলো ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদনে লাভ-ক্ষতি হিসাব দেখায় না, যা এ খাতে চলে আসা দীর্ঘদিনের সুশাসন ঘাটতির আরেকটি নজির। সাধারণত কর পরিশোধের পরই কোম্পানির লাভ-ক্ষতি হিসাব করা হয়।

যদিও দেশের জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের বিদ্যমান মডেলে আয়কর বাবদ সরকারকে পরিশোধ করা অর্থকে দেখানো হচ্ছে ব্যয় হিসেবে।

বর্তমানে দেশের বিমা খাত নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যেই আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যৌক্তিক বিমা দাবি পরিশোধে গড়িমসির কারণে পলিসিহোল্ডারদের মধ্যে খাতটির প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুনর্বিমা, দাবি নিষ্পত্তিসহ সংশ্লিষ্ট আরো নানা বিষয় নিয়েও।

মিথ্যা দাবি সাজিয়ে পুরোনো তারিখে (ব্যাক ডেট) কাভার নোট ইস্যু ও অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বিমা গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনেক। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পরিচালকদের দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণহীনতারও বহু নজির রয়েছে। একটি পরিবারের এক বা একাধিক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে পরিচালিত হচ্ছে অধিকাংশ বিমা প্রতিষ্ঠান।

উন্নত বিশ্বে ক্ষয়ক্ষতি হলে কোম্পানির লোক এসে ক্ষতি মূল্যায়ন করে পরিশোধ করে অথচ বাংলাদেশে কোম্পানিগুলোতে আবেদন করেও তেমন সাড়া মেলে না। দেশে বর্তমানে ৩৫টি জীবন বীমা ও ৪৬টি সাধারণ বিমা কোম্পানি কাজ করছে।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের জীবন বীমা খাতে ৪১ হাজার ৪৮৭ কোটি ও সাধারণ বিমা খাতে ১২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকার সম্পদ ছিল। সব মিলিয়ে বিমা খাতের মোট সম্পদের পরিমাণ ৫৩ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা।

এর মধ্যে আসবাব, জমি, ভবন, পলিসি ঋণ, বিনিয়োগ, সুদ, লভ্যাংশ, ভাড়া, রি-ইন্স্যুরেন্স বাবদ পাওনা, আউটস্ট্যান্ডিং প্রিমিয়াম, অগ্রিম ও আমানত, নগদ ও নগদের সমজতীয় এবং অন্যান্য সম্পদও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশের বিমা কোম্পানিগুলোয় সুশাসনের ঘাটতির বিষয়টি নজরে আসছে। জীবন বীমা কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত সীমার বাইরে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় অতি সাধারণ ঘটনা। অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের অর্থ লোপাটেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এদিকে বিমা কোম্পানিগুলোর মধ্যে আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা ও সুশাসনের ঘাটতি প্রকট হওয়ার কারণে এক্ষেত্রে কর ফাঁকির বিষয়টি একেবারেই অমূলক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিমা জনপ্রিয় এ কথা সত্যি। সেই তুলনায় বাংলাদেশ কিছুটা পিছিয়ে। সব দেশ তো সব সেক্টরে সমানভাবে এগোয় না। বিমা কোম্পানিগুলোর প্রত্যাশা, সরকারি নির্দেশা সবকিছু মিলে বিমাখাত সেভাবে এগোতে পারছে না।

তবে এটা বেশি দিন থাকবে না। আস্তে আস্তে বিষয়টি ঠিক হয়ে যাবে। বিমা খাতের সুশাসন নিশ্চিতের জন্য সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আমাদের অনুরোধ থাকবে, যখনই কোনো ব্যত্যয় পরিলক্ষিত হবে তখনই যাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রসঙ্গত দুর্ঘটনা কিংবা মারা যাওয়ার পরে পলিসিহোল্ডারদের বিমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে জটিলতা, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও করপোরেট সুশাসনের ঘাটতি, প্রতিষ্ঠানগুলোয় দক্ষ বিনিয়োগ ব্যবস্থাপকের ঘাটতি, মান্ধাতা আমলের বিপণন পদ্ধতি ও সেবা প্রদানের পাশাপাশি ডিজিটাইজেশনের দিক দিয়েও পিছিয়ে রয়েছে বিমা খাত।

তার ওপর একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় খাতসংশ্লিষ্টরাও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অনিয়ম ও সুশাসন ঘাটতির সমার্থক হয়ে ওঠা বিমা খাতে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির ক্ষেত্রে হিসাবমান লঙ্ঘনের বিষয়টিও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রেই কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও সম্পদ দেখানো হয় সেগুলোর বিপরীতে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ থাকে না। জমির দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। এসব বিষয়ে অনেক সময় বিমা কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা নিরীক্ষকের মতামতেও উঠে আসে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত বিভাগের পর ১৯৫৪ ও ১৯৫৮ সালে বিমা আইনে কিছু পরিবর্তন করা হয়। ১৯৫৭ সালে ভারতে বিমা ব্যবসা জাতীয়করণ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানে বিমা ব্যবসায় ব্যক্তি মালিকানাধীনেই থেকে যায়।