logo
আপডেট : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:০৪
রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বর্তমান বাস্তবতা

রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বর্তমান বাস্তবতা

বিগত প্রায় পঁচিশ বছর আগে থেকে আধুনিক গণতন্ত্রে আমি একটা বিরক্তিকর প্রবণতা লক্ষ করে আসছি। প্রাক্তন সোভিয়েত সাম্রাজ্যের দেশগুলোসহ বিশের অন্যান্য দেশের নির্বাচনগুলোতে নেতারা যথেষ্ট জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। কিন্তু এসব নেতা সে সময় এমন সব উপায় অবলম্বন করেছিলেন যা উদার গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ন করে। তারা বিরোধী দলকে উপেক্ষা করেছে। মুক্ত গণমাধ্যমকে ভীতি প্রদর্শন করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো ও আইনকে অবজ্ঞা করেছে। এমনকি নির্বাহী ক্ষমতা বা আদেশ দ্বারা শাসন করেছে। তারা জনপ্রিয় ছিল সত্য, তবে তাদের এসব কর্মকাণ্ড বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আড়ালেই থেকে গেছে।


জনসমর্থন এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থার এ সংমিশ্রণটি উৎকৃষ্ট সরকারব্যবস্থার সাংবিধানিক এবং আইনি কাঠামোকে ক্ষয় করে চলেছে। সংমিশ্রণটিকে বর্ণনা করার জন্য আমি ‘অনুদার গণতন্ত্র’ শব্দটি তৈরি করেছি। শব্দটি বর্তমান দ্বিধা কিংবা সংকটকে মেলে ধরার পাশাপাশি ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে- রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের দুটি প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথম প্রক্রিয়াটি হলো গণতন্ত্র, যা নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সাথে সম্পৃক্ত। কিন্তু উদারনীতির অন্য একটি গভীর ও দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে যা ১২১৫ সালে ম্যাগনা কার্টা দিয়ে শুরু হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিস্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য স্থান বা ক্ষেত্র তৈরি করা, যা রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেন ইউরোপের সবচেয়ে উদার রাষ্ট্র ছিল। সে সময় ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশেরও কম মানুষের ভোটাধিকার ছিল। আমরা লক্ষ করলে দেখতে পাই, রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া দুটি সম্প্রতি একত্রে মিশে গিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে উদার গণতন্ত্র তৈরি করেছে। কিন্তু বহু বছর ধরেই ঐতিহাসিকভাবে প্রক্রিয়া দুটি স্বতন্ত্র ছিল।


ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাশিয়া, ফিলিপাইন এবং পাকিস্তানে উদার গণতন্ত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমি পশ্চিমের দেশগুলোতে উদার গণতন্ত্রের বিস্তারের বিষয়টি সম্পর্কে অল্পবিস্তর উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমার বই ‘দ্য ফিউচার অব ফ্রিডম: ইলিবারেল ডেমোক্র্যাসি অ্যাট হোম অ্যান্ড অ্যাব্রোড এ আমি বেশ কয়েকটি অধ্যায়ের লেখায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। এসব লেখায় মার্কিন রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং সমাজকে পুনর্নির্মাণকারী পপুলিস্ট (জনগণবাদী) প্রবণতাগুলোর বেশকিছু বিবরণ দিয়েছি। এসব লেখায় দেখানো হয়েছে- রাজনৈতিক দলগুলোর পতন এবং রাজনৈতিক উদ্যোক্তাদের উত্থান দলীয় ঐতিহ্য এবং ইতিহাস দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু আমাকে আজ স্বীকার করতেই হবে যে, আমেরিকার ভিত্তি ও প্রাণশক্তি নষ্ট করা এ প্রবণতাগুলোকে আমি ধীরগতির ও অগভীর হিসেবে বিবেচনা করেছি। তাছাড়া আমার কাছে সে সময় এগুলোকে মার্কিন রাজনীতি কিংবা গণতন্ত্রের জন্য ততটা হুমকি হিসেবে মনে হয়নি। কিন্তু আজ এটা স্পষ্ট যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রশ্নে একটি গুরুতর হুমকির সম্মুখীন। স্নায়ুযুদ্ধ (কোল্ড ওয়ার) পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে এটা এখন অনেক বেশি গভীর।


সহজভাবে বলতে গেলে, মার্কিন ভোটারদের একটি বড় অংশ স্বীকৃত বিরোধীদেরকেও এখন আর তেমন পাত্তা দেয় না। এসব ভোটারের অধিকাংশই রিপাবলিকান পার্টির সমর্থক। এদের ধ্যানধারণা এমন যে, বিরোধী দল ভোটে জিতলে ধরে নেওয়া হবে তারা ‘জালিয়াাতির’ মাধ্যমে জিতেছে এবং সেক্ষেত্রে নির্বাচন ‘বাতিল’ হবে। এই ধরনের মানসিকতা মৌলিকভাবে উদার গণতন্ত্রের পরিপন্থী এবং এর টিকে থাকার জন্য বিপজ্জনক। এ রকম ধ্যানধারণা ইঙ্গিত দেয় যে, ভবিষ্যতের ঘটনাগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন, ভোট দমনের প্রচেষ্টা এবং নির্বাচনকে উল্টে দেওয়ার লড়াইয়ে পূর্ণ হবে। এমনকি যদি তারা ব্যর্থ হয় তবে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে বৈধতা দিতে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পঙ্গু করতে এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। ২০২০ সালের নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের পর এটি প্রমাণিত হয়েছে।


আমরা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে এ রকম জায়গায় এলাম? মার্কিন পক্ষপাতিত্বের উত্থান এবং গভীরতা সম্পর্কে জানার জন্য বিশদ অধ্যয়নের প্রয়োজন রয়েছে, যা এখন রাজনৈতিক বিভাজনের মতোই একটি সংস্কৃতি। কিন্তু যে বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে তা হলো- যেসব মৌলিক ধারণা নিয়ে ‘মার্কিন ব্যবস্থা’র সৃষ্টি হয়েছিল তা এখন অপ্রচলিত কিংবা অপর্যাপ্ত। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থপতি হলেন জেমস ম্যাডিসন। রাজনীতিকে ‘একটি বিজ্ঞান’ হিসেবে বিবেচনা করা বিশের আলোচিত বিশেষজ্ঞরা ম্যাডিসন প্রদত্ত ধ্যানধারণাকে ব্যাপক মূল্যায়ন ও অনুসরণ করেন। তারা উৎকৃষ্ট মানের সরকার সৃষ্টিকারী ‘চেক এন্ড ব্যালেন্স’ (হস্তক্ষেপমুক্ত ক্ষমতার সুষম বণ্টন বা ভারসাম্য রক্ষা) এর একটি ‘সিস্টেম (ব্যবস্থা)’ সম্পর্কে বলেছেন। সিস্টেমটিকে তারা চাকা এবং পুলিসহ একটি মেশিন বা যন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন যা গতি বা শক্তি স্থানান্তর করতে পারে। তারা মানুষের জ্ঞান বা মহত্বের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি। ম্যাডিসনের ‘ফেডারেলিস্ট পেপার’ এ একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। তিনি লিখেছেন, ‘মানুষ যদি ফেরেশতা হতো’ তবে ‘কোনো সরকারের প্রয়োজন পড়ত না’। ম্যাডিসন মূলত এমন একটি ‘সিস্টেমে’র কথা বলেছেন যেখানে ‘কাজ করার জন্য পুণ্যের প্রয়োজন নেই’। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, ‘আকাক্সক্ষাকে প্রতিহত করার জন্য উচ্চাকাক্সক্ষা তৈরি করতে হবে’। তার দাবি, এই স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকেই কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অভ্যুদয় ঘটে। ম্যাডিসনের এই ‘আমেরিকান মডেল’ সারা বিশে ‘নিয়ামক বা মানদণ্ড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে এখন উল্টোটা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ম্যাডিসনের ধারণাগুলোর বাস্তবরূপের কি চিত্র দেখতে পাচ্ছি আমরা? শাসকের ফেরেশতা, নীতিবান বা মহৎ হওয়ার ক্ষেত্রে কিংবা সিস্টেমকে চাকাসহ মেশিনের প্রশ্নে বর্তমানে কী ঘটছে? লক্ষ করা যাচ্ছে- বিশব্যাপী রাজনীতি ও গণতন্ত্র ততটা ভালোভাবে কাজ করছে না। রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক কাঠামো অনেক দেশেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। আবার কোনো কোনো দেশে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে এবং যেসব দেশে এখনো কাজ করছে সেখানে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে। জার্মানি এবং জাপানের দিকে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? এ দুই দেশ পুরোপুরিভাবে পপুলিজম (জনতাবাদ) এবং ন্যাশনালিজমের (জাতীয়তাবাদ) মুখোমুখি হয়নি আজো। এ দুই দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ব্যাপক চাপ সামলে চলতে হচ্ছে। জাপান বা জার্মানির মতো দেশগুলোতে গণতন্ত্র কিংবা রাজনীতি তাদের সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের দ্বারা টিকে আছে। অথচ গণতান্ত্রিক কাঠামোর এ দুটির ওপর ভর করে চলার কথা নয়। রাজনীতি বা গণতন্ত্রের পরিচালিত হওয়ার কথা তার নিজস্ব মৌলিক ব্যবস্থাপনায়।


তাহলে সারাবিশে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থাটা কী দাঁড়াল? হ্যাঁ, সর্বত্রই মার্কিন লেখক ও দার্শনিক র‌্যালফ ওয়াল্ডো এমারসনের ধারণা সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছে, ‘রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল শাসকদের দীর্ঘায়িত ছায়া’। রাজনীতি কিংবা গণতন্ত্রের সামনে শাসকেরা ন্যায়-নীতি পরায়ণ ও মহৎ ফেরেশতা হয়ে হাজির হচ্ছে। যদি এই শাসকেরা ব্যর্থ হয় বা ভালোভাবে কাজ করতে না পারে কিংবা নৈতিকভাবে বা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে কাজ করে, তবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। অথচ গণতন্ত্রকে নিজস্ব ভিত্তিব্যবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে চলার কথা! যে আলোকিত ধারণাগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমেরিকায় গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল তারচেয়েও অনেক পুরনো একটি প্রশ্নকে সামনে রেখে আমরা একুশ শতকে প্রবেশ করেছি।


প্রাচীন গ্রিক এবং রোমানদের মাঝেও এই প্রশ্নটি নিয়ে আলোচনা ছিল। দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময় আগে থেকে আজ অবধি সেই একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে! প্রশ্নটি হলো ‘আমরা কীভাবে মানুষের (শাসকের) মধ্যে সদগুণাবলি উৎপন্ন করব?’ আসলেই তো, গণতন্ত্র ও রাজনীতি একটি শক্ত ভিত্তিব্যবস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে। তা না হয়ে, দেশের ইতিহাস বা সংস্কৃতির ওপর ভর করে অথবা শাসকের মধ্যে মহৎ গুণাবলি উৎপন্ন করে গণতন্ত্র বা রাজনীতির সৃষ্টি বা টিকে থাকার যৌক্তিক ভিত্তি বা সম্ভাবনা কতটুকু?

লেখক: সিএনএনের জিপিএস হোস্ট ও দ্য ওয়াশিংটন
পোস্টের কলামিস্ট
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ সুজন