আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০ দলের বাইরে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোটের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসতে যাচ্ছে দলটি। চলছে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি। ৮১ দিন পর হাসপাতাল থেকে গত মঙ্গলবার বাসায় ফিরেছেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
সংলাপের বিষয়ে এবার তারিখ নির্দিষ্ট হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে বিএনপির জোটের কলেবর বাড়ানো বা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন নিয়ে চিন্তিত নয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, বিএনপির জনসমর্থন নেই। তাই তারা যতই পরিকল্পনা করুক কোনো কাজ হবে না। ভোটাররা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন থেকে দলটি নিজেদের গুটিয়ে রেখেছে।
আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, বিএনপি সবাইকে নিয়ে ক্ষমতায় যেতে নতুন করে ষড়যন্ত্র করতে পারে। এমন হলে ২০-দলীয় জোটের অশুভ তৎপরতাকে মোকাবিলা করবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। প্রয়োজনে আবারও চাঙা করা হবে ১৪ দল তথা মহাজোটকে। সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে দেশবিরোধী শক্তিকে রাজপথে মোকাবিকলার জন্য প্রস্তুত আওয়ামী লীগ।
আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে ১৪ দলকে আবারও চা ঙা করার কথা বলছেন দলটির নেতারা। ১৪ দলের শরিক নেতারা বলছেন, জোট কার্যত মৃত। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে নিয়ে পথ চলবে কি না তা স্পষ্ট নয়। এ নিয়ে জোটের শরিকদের মধ্যে রয়েছে চাপা ক্ষোভ।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, বিএনপির জোট হবে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে নিয়ে। যারা দেশে লুটপাট ও সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এ ধরনের দল নিয়ে তারা বেশি দূর যেতে পারবে না। কারণ এ ধরনের জোট জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। ফলে আন্দোলন করেও তারা সুফল পাবে না। মানুষ এখন আন্দোলনমুখী নয়।
তাছাড়া আওয়ামী লীগ মনে করে ক্ষমতার মালিক জনগণ। তাই দশম নির্বাচনে দেওয়া ইশতেহার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে আগামী নির্বাচনে নতুন নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে মানুষের কাছে যাবে দলটি। এতে ভোট আরো বাড়বে। দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ছাড়া জনস্বার্থে বিএনপির কোনো অর্জন নেই। তাই বিএনপি যতই জোটের কলেবর বাড়াক না কেন, ভোট বাড়বে না।
গত ৩ জানুয়ারি বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ৪ জানুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানান দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
ফখরুল বলেন, সভায় নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সমমনা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের বিষয়ে আলোচনা হয়। সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বরাবরই জাতীয় ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। জোটের ব্যাপারগুলো ইম্পরটেন্ট না। এগুলো গঠিত হয়েছে সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায়। মতবিনিময়ের উদ্দেশ্য হলো বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা।
সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে বিএনপির কথিত আন্দোলনের অবজেক্টিভ কোনো অবস্থা নেই। করোনাভাইরাসের অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশের মানুষ এখন নিজের অবস্থান উন্নয়নে প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় গণ-অভ্যুত্থানের দিবাস্বপ্নে বিভোর বিএনপি। দলটি ভাবছে, আন্দোলনের ডাক দিলেই মানুষ হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসবে।
প্রকৃতপক্ষে এসব তাদের আকাশ-কুসুম ভাবনা। বিএনপি নেতারা যা বলছেন, নিজেরাও সেটি বিশ্বাস করেন না। বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, করোনার নতুন ঢেউয়ের কারণে তাদের দলীয় কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিভাগীয় পর্যায়ে সভা-সমাবেশ শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় করা হবে। এজন্য সব দলকে চিঠি দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
সূত্র বলছে, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিএনপির মূল লক্ষ্য। যে দলগুলো ২০-দলীয় জোটে নেই সেগুলোকে কাছে টানতে চায় বিএনপি। নির্বাচনের আগে আগে তাদের নিয়ে বৃহত্তর জোট ঘোষণা দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে বড় বাধা জামায়াত। বিএনপির একটি অংশ চায় জামায়াত বাদ দিয়ে পথ চলতে। আরেকটি অংশ চায় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে চলার।
তবে জামায়াত জোটে থাকলে বামপন্থি অনেক দলই বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নয়। এজন্য জামায়াত প্রশ্নে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় সরকারবিরোধী এই জোট। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপির রাজনৈতিক সংলাপ বা জোট নিয়ে আমাদের তেমন একটা ভাবনা নেই।
তবে বিএনপি কাদের নিয়ে সংলাপ করবে, নতুন করে কারা তাদের জোটে যাচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। তবে আমরা বিশ^াস করি, মানুষ বিএনপিকে গ্রহণ করবে না। তাই এ নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই।
তিনি বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের আস্থা অর্জন। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ইসি গঠনের দিকে আমরা তাকিয়ে আছি। কারা নতুন ইসির দায়িত্বে আসছেন। সেইসঙ্গে গত নির্বাচনে আমরা ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তা কতটুকু বাস্তবায়ন হলো তা দেখা হচ্ছে। যেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি তা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করতে হবে।
১৪-দলীয় জোটের পরিধি বাড়বে কি না এমন প্রশ্নে বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ১৪ দল হলো আমাদের আদর্শিক জোট। নির্বাচনের আগে এমনিতেই ১৪ দল সরব হবে। প্রয়োজনে ১৪ দলের শরিকদের নিয়ে সব অপশক্তি অতীতের মতো মোকাবিলা করা হবে।
তিনি বলেন, আমরা বিএনপিকে অনুসরণ করি না। আওয়ামী লীগ নীতি-আদর্শ অনুযায়ী চলে। তাই বিএনপি জোটের কলেবর বাড়ালে আমাদের বাড়াতে হবে বা রাজনৈতিক সংলাপ করতে হবে বিষয়টি এমন নয়।
বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক গণতন্ত্রী পার্টির শীর্ষ নেতা নূরুর রহমান সেলিম ভোরের আকাশকে বলেন, ১৪-দলীয় জোট এখন আর আগের মতো সক্রিয় নেই।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ একলা চলো নীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৪ দলের শরিকদের মধ্যেও দূরত্ব অনেক বেশি বেড়েছে। ১৪ দলের অনুষ্ঠান হয় না, বৈঠক কম হয়। তাই ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ ১৪ দলকে নিয়ে পথ চলবে কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে আওয়ামী লীগ যদি প্রয়োজন মনে করে তাহলে আমি মনে করি শরিকদের অনেকেই হয়তো আগের মতো সক্রিয় হয়ে রাজপথে দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখবে।
আগামী নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পথ চলতে কতটুকু প্রস্তুত জানতে চাইলে ১৪ দলের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া ভোরের আকাশকে বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের কোনো বৈঠক বা প্রস্তুতি এখনো হয়নি। ১৪ দলকে নিয়ে আগামীতে পথ চলবে কি না সেটাও আওয়ামী লীগের বিষয়।
তিনি বলেন, ১৪ দলের সঙ্গে কোনো দূরত্ব আছে কি না তা আওয়ামী লীগ ভালো বলতে পারবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের জোটের শরিকরা এক হলেও সাম্যবাদী দলের আর আওয়ামী লীগের পক্ষে থেকে কাজ করা সম্ভব হবে না।