logo
আপডেট : ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:২২
সেনাশাসিত মিয়ানমার
প্রিয়জন হারানোর আতঙ্কে দিন কাটছে প্রবাসীদের
মোমেনা আক্তার পপি

প্রিয়জন হারানোর আতঙ্কে
দিন কাটছে প্রবাসীদের

জাপানের একটি কারিগরি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিয়ানমারের তরুণ লিয়ান চেউয়ের প্রতিটি দিন কাটছে আতংকের মধ্যে। তার শুধু মনে হয়, এই বুঝি পরিবারের লোকজনের কোনো দু:সংবাদ আসল। গত সেপ্টেম্বরে চীন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় বাস্তুচ্যুত হয় তার পরিবার।


পড়াশোনার ফাঁকে রেস্টুরেন্টে খণ্ডকালীন কাজ করা ২৬ বছর বয়সী লিয়ান তার মোবাইলে রাখা বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিছু ছবি দেখছিল। বলে-মানুষ কি করে এমন কাজ করতে পারে। কোনো মানুষের পক্ষে কি এসব কাজ করা সম্ভব।

মূলত জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ দমাতে জনমনে ভীতি সঞ্চার করার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী এ ধরনের কর্মকা- চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের হিসেবে মিয়ানমারে চলমান জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ সহিংসতায় অন্তত ৩ লাখ ২০ হাজার ৯০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

এই বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে রয়েছে লিয়ানের বাবা-মা ও ১৪ বছর বয়সী ভাই। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থান ও গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সুচিকে আটক করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে দেশটিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে।


বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে ১ লাখ ৩২ হাজার ২০০ মানুষ চীন রাজ্য ও পাশের দুই অঞ্চলের। সেনাবাহিনী ও চীনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সের (সিডিএফ নামে পরিচিত জান্তা বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ) দ্বন্দ্বে পড়ে এসব লোক বাস্তচ্যুত হয়।

এই সিডিএফ জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিলে কাজ করছে। যদিও জান্তার মতে এসব সন্ত্রাসীগোষ্ঠী মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।

সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমারে মানবিক সংকটের জন্য জান্তা সরকার দায়ী। জাতিসংঘের মতে, অতি সত্বর খাদ্য ও চিকিৎসামগ্রী প্রয়োজন-এমন মানুষের সংখ্যা দ্রুত ১ কোটি ৪৪ লাখে পৌঁছেবে।

যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। সর্বশেষ সেনা অভ্যুত্থানের আগে এরকম মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ লাখ। এসিসট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স নামে স্থানীয় এক পর্যবেক্ষণ গ্রুপের মতে, মিন অং হ্লাইয়ের নেতৃত্বাধীন জান্তা সরকার গত এক বছরে অন্তত ১৫শ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীকে গুলি করে হত্যা করে।

লিয়ান বলেন, আমি প্রতিদিনই উদ্বেগের মধ্যে থাকি, মনে হয় এই বুঝি খবর এলো সিডিএফের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন অভিযোগ এনে আমার বাবা-মা ও ভাইকে জান্তা সরকার আটক করেছে বা হত্যা করেছে। আমার পরিবারের লোকজন এখন কোথায় আছে তা আমি জানি না।

অনেক দিন ধরে আমি তাদের কোনো খবর পাচ্ছি না। জান্তা সরকার ফের তাদের ওপর বিমান হামলা চালাতে পারে; সারাক্ষণ এই ভয়ে থাকি।


জাপানের রাজধানী টোকিওর বাণিজ্যিক জেলা ইকেবুকেরোর স্প্রিং রেভ্যুলেশন রেস্টুরেন্টে বসে লিয়ান গত ৯ জানুয়ারি এসব কথা বলেন। জাপানে বসবাসরত গণতন্ত্রপন্থি মিয়ানমারের একদল মানুষ গত বছরের জুনে একটি খাবারের দোকান খুলে।

এখান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তারা নিজ দেশে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করতে চায়। উদ্বোধনী দিনে রেস্টুরেন্টটিতে চীনের ঐতিহ্যবাহী খাবার পরিবেশন করা হয়।

এই রেস্টুরেন্ট থেকে অর্জিত অর্থ ও অনুদান নিজ অঞ্চলের বাস্তচ্যুত মানুষের জন্য ব্যয় করা হবে বলে জানান লায়ে লায়ে ল্যুইন নামের এককর্মী। ল্যুইন টোকিওর একটি হাসপাতালে নার্সের কাজ করে। বলেন, আমি নিজ এলাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার খুব আনন্দ নিয়ে খাচ্ছি।

কিন্তু আমি চাই, জাপানে বসবাসরত মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলের নাগরিকরা চীন রাজ্যের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হোক। এতে আমাদের মধ্যে বন্ধন আরো দৃঢ় হবে এবং সবাই একত্রিত হয়ে জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারব। মিয়ানমারের প্রায় ৩২ হাজার মানুষ জাপানে বসবাস করে।

ল্যুইন ও রেস্টুরেন্টের অন্য কর্মীদের বক্তব্য হলো, আমরা চায় মিয়ানমারে কি হচ্ছে সে সম্পর্কে জাপানের মানুষ জানুক। বিশেষ করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী নারী ও শিশুদের জান্তা সরকার কিভাবে হত্যা করছে সে সম্পর্কে আমরা জাপানকে ধারণা দিতে চাই।

বলতে চাই, জাপান যেন বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে জান্তা সরকারের এসব কর্মককা- বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ৩১ বছর বয়সী ল্যুইন আরো বলেন, সিডিএফ কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়।

এই সংগঠনে শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, নার্স এবং সাধারণ মানুষ রয়েছে। তারা শান্তি, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পেরে উদ্বোধনী দিনে এক জাপানি ১ লাখ ইয়েন (৮৭০ ডলার) অনুদান দেন। এটা আমাকে খুবই হতবাক করেছে।

রেস্টুরেন্টে নিজ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার রাখার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। আসছে ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে রেস্টুরেন্টে মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় কিয়ান রাজ্যের (কারেন নামে পরিচিত) খাবার পাওয়া যাবে।


বহু জাতিগাষ্ঠী অধ্যুষিত মিয়ানমারে কয়েকদশক ধরে জাতিগত সংঘাত চলছে। এ কারণে সব জাতিকে এক ছাতার নিচে আনা সত্যিই কষ্টকর। কিন্তু আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য, জান্তাকে ব্যারাকে পাঠানো।

সুযোগ এসেছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও মিয়ানমারের জনগণের একত্রিত হওয়ার এবং জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার।


গণতন্ত্রপন্থি সংসদ সদস্য, অভ্যুত্থানবিরোধী নেতা ও প্রতিনিধি এবং ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গত বছর এপ্রিলে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট নামে (এনইউজি) জান্তাবিরোধী একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করা হয়।

এর নেতৃত্বে রয়েছে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় কাচিন রাজ্যের নেতা আইনজীবী দুয়া ল্যাসি লা। শুরু থেকেই এনইউজি সহিংসতা পরিহার, সুচির মুক্তি ও নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।


সুচির বিরুদ্ধে আন্দোলন সহিংসতায় উস্কানিসহ বেশকিছু অভিযোগ এনেছে জান্তা সরকার। কিছু কিছু অভিযোগে মিয়ানমার আদালত সুচিকে কয়েক বছরের কারাদ-ও দিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, জান্তা সরকার নিজেদের বৈধতা দিতে এবং নোবেল পুরস্কার জয়ী নেত্রী সুচি যাতে আর রাজনীতিতে আসতে না পারে সেজন্য এসব করছে।

লিয়ান এবং ল্যুইন এনইউজিকে মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসাবে স্বীকৃতি দিতে জাপান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বলেন, আমরা চাই- জান্তা সরকারকে দেওয়া সব ধরনের সহায়তা প্রত্যাহার ও সেনাসংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্যদিয়ে জাপান যেন নতুন সরকারকে সহযোগিতা করে।


অভ্যুত্থানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশকিছু পশ্চিমাদেশ জান্তা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। কিন্তু জাপান সামরিক সরকার ও এনইউজি উভয়ের সঙ্গেই সম্পর্ক রেখে চলছে।

এ ধরনের কৌশল সংকট নিরসনে কখনোই কার্যকর নয়। আমরা আর মিয়ানমারে রক্তক্ষয়ী সহিংসতা দেখতে চাই না। তারওপর রয়েছে করোনা মহামারির ছোবল। লিয়ান ও ল্যুইন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদার উদ্দেশ্যে বলেন, মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়ান, এনইউজেকে সমর্থন দিন।


লিয়ান বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল হোটেল ব্যবসার মাধ্যমে মিয়ানমারের কিছু এলাকার উন্নয়ন করা। কিন্তু এই অভ্যুত্থান শুধু আমার স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করছে তা নয়, আমার পরিবারকে করেছে গৃহহারা।

সামরিক সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমার এসব স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়। ততদিন পর্যন্ত জাপানে কাজ করে নিজ পরিবারকে সাহায্য ও এনইউজিকের হয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাব।

-কিয়োডো নিউজ অবলম্বনে