অনিশ্চয়তাকে সাথে করে ২০২২ সালে আমরা নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর মহামারির তৃতীয় বছরে প্রবেশ করেছি। এত এত যন্ত্রণা ও বিষাদের মধ্যেও আমাদের পৃথিবীকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। আলজাজিরায় প্রকাশিত একটি মন্তব্য প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, করোনা মহামারি যখন প্রথম আঘাত হানে, ধনী-দরিদ্র সবাই ভয়ে এক ছাতার নিচে চলে এসেছে। পৃথিবীর পরাক্রমশালী দেশগুলোর রাজনীতিবিদরা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী স্বার্থপরতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল। তারা বাণিজ্যিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ভয়ানক লাভের আকাঙ্ক্ষাকে তিরস্কার করতে শুরু করল এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন যে, করোনা ভ্যাকসিন হবে এই পৃথিবীতে বসবাসরত সকল জনসাধারণের সম্পদ।
এসব কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে তখন মনে হচ্ছিল যে, মানুষকে বাঁচাতে সবার মধ্যে একটা সংহতির জন্ম হয়েছে। করোনার কারণে বিভিন্ন দেশের সরকারি হিসেবে ৫.৫ মিলিয়নেরও বেশি মৃত্যু হলেও প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। ধারণা করা হয় এই মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১৯ মিলিয়নেরও বেশি। মহামারিকালীন সময়ে এই মৃত্যুর মিছিল সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি কিছু মানুষ এই মহামারিকে পুঁজি করে কোটিপতি হচ্ছে। এই করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো মানবতার এই সংকটের মধ্যেও এখনো লোভ সংবরণ করতে পারছে না। মহামারির তৃতীয় বছর ২০২২ সাল আমরা শুরু করেছি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধির বড় রেকর্ড করার মধ্যদিয়ে। এই মহামারি চলাকালীন প্রতি ২৬ ঘণ্টায় একজন বিলিয়নিয়ারের জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে। বিশ্বের ১০ জন শীর্ষ ধনী ব্যক্তির সম্পদ দ্বিগুণ হয়েছে এবং প্রতি সেকেন্ডে তাদের সম্পদ বেড়েছে ১৫,০০০ ডলার করে। অন্যদিকে ৯৯ শতাংশ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে কোভিড-১৯।
আমাদের জন্য বড় অস্বস্তির জায়গা হচ্ছে বৈষম্য। ২০২১ সালে ধনী দেশগুলোর ওষুধ শিল্পের একচেটিয়া ব্যবসা ও মুনাফার কারণে দরিদ্র দেশগুলোতে লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে ভ্যাকসিনের অভাবে। করোনা মহামারিতে আমরা কোটি কোটি মানুষকে টিকা থেকে বঞ্চিত করে নতুন ভ্যাকসিন বিলিয়নিয়ার তৈরি করেছি। ভ্যাকসিন এবং মানুষের মৃত্যু এখন আর গরিব আর ধনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পার্থক্য এখন অতি ধনী বনাম বাকি সবাই।
অক্সফার্ম ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বৈষম্যের কারণে প্রতি চার সেকেন্ডে অন্তত একজনের মৃত্যু হচ্ছে। এই মৃত্যুর পরিসংখ্যানটি যদিও রক্ষণশীল অনুমানের ওপর ভিত্তি করে গড়া। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি।
অতি ধনী বৃদ্ধির এই প্রবণতাকে আমরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারি। এই ধনী বৃদ্ধির প্রবণতা অক্সফামের ‘ইনইকুয়ালিটি কিলস’ নিবন্ধের বাইরে আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে বিলিয়নেয়ার সম্পদ বেড়েছে আগের ১৪ বছরের মোট সম্পদ বৃদ্ধির চেয়েও বেশি। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, ক্রেডিট সুইস এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) দেশে দেশে সম্পদ বৃদ্ধির এই বৈষম্য অনেক আগেই অনুমান করছে।
অতি ধনীরা এই মহামারিতে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছে। অর্থনীতিকে মন্দা থেকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ট্রিলিয়ন ডলার ছাড় করলেও সেই অর্থ শেষ পর্যন্ত ধনকুবেরদের পকেটেই গেছে। এর ফলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একচেটিয়া বিপণন ব্যবস্থার উত্থান হয়েছে। মহামারির এই সময়ে বেসরকারিকরণ বেড়েই চলছে, শ্রমিকরে অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে, মূলধন ও কর্পোরেট করের হার হ্রাস পেয়েছে।
একদিকে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ দিন দিন গভীরতর অর্থনৈতিক বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে। কিছু দেশে ধনী দেশের তুলনায় গরিব দেশে প্রায় চারগুণ বেশি মানুষ কোভিড-১৯-এ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রায় ৩.৪ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান আজ জীবিত থাকত যদি তাদের আয়ু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের মতোই হত। লিঙ্গ সমতা আগের চেয়ে ভালো হলেও অনেক দেশে নারীরা লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতার দ্বিতীয় মহামারির সম্মুখীন হচ্ছে।
ভ্যাকসিনের কারণে সৃষ্ট বৈষম্য অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ও উস্কে দিচ্ছে। তারমধ্যে আইএমএফ সমর্থিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধর প্রকল্প বিশ্বের ৮০ টি দেশের অবস্থা আরো খারাপ হবে।
করোনা মহামারি, ভ্যাকসিন স্বল্পতা এবং কোটিপতি তৈরির গতির কারণে আমরা এখন ভুল নীতির ইতিহাস তৈরি করছি। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের চেয়ে ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক বৈষম্য এখন অনেক বেশি দৃঢ়। ১৯ শতকের শেষের দিকের সোনালি যুগ আমরা অতিক্রম করে এসেছি।
প্রতিবেদনটিতে মন্তব্য করা হয়েছে, প্রতিটি সরকারকেই বৃহত্তর অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করতে এবং লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ২১ শতকের উপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া এখন সামাজিক আন্দোলনেরই অংশ। সামাজিক আন্দোলন হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া প্রগতিশীল সরকারগুলোর ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির এক বড় শিক্ষা।
মানুষের জীবন বাঁচাতে আমরা ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থছাড় অর্থনীতির ভালো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারি। আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোর উদাহরণ এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতি ধনীদের ওপর কর আরোপ করে আমরা বিশাল একটা ফান্ড তৈরি করতে পারি যা দিয়ে অর্থনীতিকে আমরা টেনে তুলে ধরতে পারি।
এই মুহূর্তে, ধনী সরকারগুলোর জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনগুলোর ওপর থাকা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার ভেঙে দেওয়া, যাতে আমরা সারাবিশ্বে ভ্যাকসিনের টিকা দিতে পারি এবং এই মহামারির এই কালো অধ্যায় শেষ করতে পারি।
আল জাজিরা থেকে অনূদিত