logo
আপডেট : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০৮:০০
ইতিহাস নিয়ে কল্পকাহিনি
নিজস্ব প্রতিবেদক

ইতিহাস নিয়ে কল্পকাহিনি

‘আমরা জানি, ইতিহাসকে হতে হয় সত্যনিষ্ঠ; সত্যকে ধারণ করতে হয় শুধু বাস্তবতার খাতিরেই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঐতিহ্য সৃষ্টির কারণেও। তাই একুশের ইতিহাস নিয়ে তথ্যগত যথেচ্ছাচারের বিষয়টি একেবারে গুরুত্বহীন বলে এড়িয়ে দেওয়া চলে না। কিছু না কিছু আলোচনার দায় এক্ষেত্রে গ্রহণ করতেই হয়। আর সেই আলোচনার সূত্রেই লক্ষ করা যায় যে, একুশের ইতিহাসে কিছু না কিছু কল্পকাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটেছে; এমনকি কিছু অমূলক কৃতিত্বের দাবিও উঠেছে। এ প্রবণতা বিগত কয়েক বছরে সম্ভবত সর্বাধিক’।

ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন ও আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও তাৎপর্য ’গ্রন্থে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বইটির ৮৪-৮৫-৮৬ নম্বর পাতায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে কল্পকাহিনি প্যারায় বলা হয়েছে, এ সম্পর্কে তমদ্দুন প্রসঙ্গ ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। এরপর একুশের ভাষা আন্দোলনে জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিই ধরা যাক।

এ সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করতে চাইলে দেখা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমান (তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক) ১৯৫০ সাল থেকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে জেলে আটক রয়েছেন। জেলে থাকার সময় শেখ মুজিবুর রহমান এবং মহিউদ্দিন আহমদের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায় ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কালে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মুক্তির দাবিতে তারা অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এ সময়ে তাদের ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। অনশন ও স্থানান্তরের তারিখ নিয়ে যথেষ্ট ভিন্নমত দেখা গেছে।

কিন্তু সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন এবং মওলানা ভাসানীর বিবৃতি থেকে মনে হয়, ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকেই তারা অনশন শুরু করেন। এ সম্পর্কে মওলানা ভাসানী বলেন, ‘আমি জানিতে পারিয়াছি যে, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হইতে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন।... আমি মানবতার নামে আবেদন করিতেছি যে, আশঙ্কাজনক স্বাস্থ্যের দিকে চাহিয়াও যেন তাহারা শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদকে মুক্তি দেন।’

বলা বাহুল্য, তাদের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক চাপ, ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা এবং সর্বোপরি তাদের অনশন ধর্মঘটের কারণে সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমদকে ফরিদপুর জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। আন্দোলন তখনো চলছে। কিন্তু সদ্যমুক্ত শেখ সাহেব তখন ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ না দিয়ে সম্ভবত স্বাস্থ্যগত কারণে তার গ্রামের বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন (আজাদ, ৮-২-৫২)। শুধু তাই নয়, দুই মাস পর নতুন করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ সাহেবের বক্তৃতা থেকেও এই ঘটনা সঠিক মনে হয়। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষা সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত।’

এমনি একাধিক তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, একুশের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অথচ দীর্ঘকাল পর বৃথাই। একুশের আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে ‘মিথ’ তৈরির চেষ্টা চলেছে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, সে চেষ্টা এখনো চলছে এবং এজন্য দায়ী কয়েকজন স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি। এতে করে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মর্যাদা ক্ষুণ্নই হয়েছে।

এদের কেউ বলেছেন, ‘১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নির্দেশ’ শেখ সাহেবই দেন; কেউ বলেন : ‘পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পরিকল্পনাও তার’, আবার কারো মতে, ‘তিনিই আন্দোলনের মূল ব্যক্তি। এমনকি কার্জন হলে প্রদত্ত জিন্নাহর সমাবর্তন বক্তৃতার বিরুদ্ধে তিনিই প্রতিবাদ করেন, এমন দাবিও করা হয়েছে, অথচ সবাই জানেন শেখ সাহেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক।

এসব বিষয়ে জিল্লুর রহমানের বক্তব্যই প্রথম ধরা যাক। তিনি বলেছেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধুই আমাদের নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের প্রথমদিনই পরিষদ ভবন ঘেরাও করার জন্য বলেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন, যে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে তিনি আমরণ অনশন করবেন।

এ ধরনের বক্তব্য আরো অনেকে রেখেছেন যা আদৌ সঠিক নয়। যেমন খন্দকার গোলাম মোস্তফা (সেকালে ‘কে.জি.এম’ নামে সুপরিচিত) একসময় এ সম্পর্কে এমন কিছু বক্তব্য পরিবেশন করেছিলেন যা সে সময়ই যথেষ্ট সমালোচিত হয়েছিল।