দেশজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দুই বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মাঝখানে কিছুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও বর্তমান করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ওমিক্রনের কারণে আবার বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়।
আর এই করোনাকালে জয়পুরহাটে বাল্যবিবাহর শিকার হয়েছে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসাগুলোর বিপুলসংখ্যক ছাত্রী। বিদ্যালয় বন্ধের অজুহাতে ও সামাজিক নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে গ্রামের দরিদ্র, অসচেতন পরিবারগুলো কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছে।
বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আশঙ্কা, বিদ্যালয় দ্রুত খুলে না দিলে বাল্যবিয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে।
জয়পুরহাট জেলা প্রশাসকের শিক্ষা কার্যালয় এবং জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়ের তথ্য সূত্রে জানা যায়, জেলায় গত ২০১৯ সালে মাধ্যমিক (এসএসসি) ও সমমানের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল ১৪ হাজার ১৩২ জন। ছাত্রী ছয় হাজার ৫০৪ এবং ছাত্র ছিল সাত হাজার ৬২৮ জন।
২০২০ সালে পরীক্ষার্থী ছিল ১২ হাজার ১১৬ জন। ছাত্রী ছিল পাঁচ হাজার ১৬৩ এবং ছাত্র ছিল ছয় হাজার ৯৫৩ জন। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী কমেছে দুই হাজার ১৬ জন।
আর ২০২১ সালে জেলায় মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি (ভোকেশনাল) বিভাগে ১৩ হাজার ২২৬ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেওয়ার আবেদন করে। তাদের মধ্যে ১২৩ জন ছাত্রী এবং ৭২ জন ছাত্র পরীক্ষায় অংশ নেয়নি।
শিক্ষকরা বলছেন, সিংহভাগ ছাত্রী বাল্যবিবাহর কারণে পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। আর ছাত্ররা কেউ কেউ রাজমিস্ত্রির সহকারী বা রিকশা-ভ্যান চালিয়ে সংসারে আর্থিক সহযোগিতা করছে।
জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। করোনার সময়ে বিয়ে হচ্ছে অতি গোপনে আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। এ কারণে প্রশাসন এবং শিক্ষকরাও জানতে পারছেন না বাল্যবিবাহের কথা।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, আগে কোনো ছাত্রীর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলে ওই ছাত্রীর সহপাঠীর মাধ্যমে শিক্ষকরা খবর পেতেন। তখন প্রশাসনের সহায়তায় অনেক বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পেরেছেন শিক্ষকরা।
জয়পুরহাট সদর উপজেলার চাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলমগীর কবীর জানালেন, তার বিদ্যালয়ের এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল ৪৫ জন। এদের মধ্যে এবার পাঁচজন মেয়ের বাল্যবিবাহ ও তিন ছাত্র দারিদ্র্যের কারণে এসএসসি পরীক্ষার দেয়নি।
ভাদসা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু তৈয়ব মন্ডল বলেন, ‘২০২১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আবেদন করেনি পাঁচজন মেয়ে। করোনাকালে তার বিদ্যালয়ের সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির আরো আটজন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।’
জয়পুরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দোগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন মনে করেন, করোনাকালে গ্রাম পর্যায়ে ছাত্রীরা বাল্যবিবাহর শিকার হচ্ছে।
জেলায় মাধ্যমিক এবং দাখিল মাদ্রাসা ও কারিগরি বিদ্যালয় রয়েছে ২৮১টি। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় যেমন বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে ছাত্রীরা তেমনই কিছু কিছু ছাত্র ভ্যান রিকশা চালিয়ে এবং রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করছে। এসব শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়মুখী করতে শিক্ষক সমিতি কাজ করছে।
একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, তারা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে গিয়ে স্থানীয়ভাবে শক্রতার মুখে পড়েন।
জয়পুরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) শাহাদুজ্জামান বলেন, ‘বাল্যবিবাহ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা এগিয়ে এলে বাল্যবিবাহ রোধ করা সম্ভব।
‘সচেতনতামূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে বাল্যবিবাহ অনেকটা কমানো সম্ভব। এ নিয়ে শিক্ষা বিভাগ এবং জেলা প্রশাসন কাজ করছে।’