logo
আপডেট : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:২৭
‘রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত’
নিজস্ব প্রতিবেদক

‘রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত’

প্রতীকী ছবি

১৯৪৭ সাল থেকেই মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ওঠে। ধীরে ধীরে তা আন্দোলনে রূপ নিতে থাকে। এরই মধ্যে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত প্রকাশ হতে দেখা যায়। যা ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বইতে উঠে এসেছে।

বইয়ের ৩১ থেকে ৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক ও উত্তাপ-উত্তেজনা দেখা দিতে থাকে বিভাগপূর্ব সময় থেকেই। মুসলিম লীগের নেতৃত্ব ধরেই নেয়, হবু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অবশ্যই হবে উর্দু, যদিও সেখানে বাংলাভাষী মানুষ হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিষয়টা যখন বক্তৃতা-বিবৃতিতে প্রকাশ পায়, তখন বাঙালি শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কেউ কেউ কলম ধরেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে’।

বইতে আরো লেখা আছে, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ১৯ মে (১৯৪৭) হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত উর্দু সম্মেলনে চৌধুরী খালিকুজ্জামান বলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে।’ বলেছেন আরো একাধিক মুসলিম লীগ নেতা। কলকাতায় অবস্থিত ‘আজাদ’ ‘ইত্তেহাদ’ ‘মিল্লাত’ এসব পত্রিকায় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। লেখেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক আবদুল হক, মাহবুব জামাল জাহেদী, আবদুল মতিন, কাজী আবুল হোসেন প্রমুখ। লেখেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো পণ্ডিত ব্যক্তি’।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বইতে আরো লেখা হয়েছে, ‘কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার (১৪ আগস্ট, ১৯৪৭) পর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নতুন করে বিতর্কের সূচনা। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দির (হিন্দিস্থানি) সম্ভাবনা ও জাকির হোসেনের মন্তব্যের বরাত দিয়ে প্রচার শুরু হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে মুসলিম সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উর্দু ভাষা। আশ্চর্য, বাঙালি শিক্ষক, সাহিত্যিকের একাংশ এবং মুসলিম লীগের বাঙালি রাজনীতিক প্রায় সবাই বলতে থাকেন, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। মওলানা আকরম খাঁর মতো চতুর সাংবাদিক-রাজনীতিক, যুক্তির মারপ্যাঁচে বলেন, পূর্ববঙ্গে বাংলা এবং কেন্দ্রে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হওয়াই সঙ্গত’।

‘ঢাকা প্রকাশ’ পত্রিকায় (২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭) লেখা হয় : ‘রাষ্ট্রভাষা সম্পূর্ণ নতুন হইলে দেশের প্রত্যেকটি লোকই অশিক্ষিত বলিয়া গণ্য হইবে, সর্ব্বপ্রকার কার্য্যেই প্রত্যেকটি লোকের বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হইবে, তদুপরি ভাষাগত অশিক্ষার দরুণ উপযুক্ত ব্যক্তির পক্ষেও চাকরি এবং ব্যবসা ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব হইবে।’

এ বক্তব্য আবদুল হকের বক্তব্যের অনুরূপ যে ‘রাষ্ট্রভাষা উর্দু হইলে পাঁচ কোটি বাঙালি চাকরির অনুপযুক্ত হইয়া পড়িবে। পাঁচ কোটি হোক বা চার কোটি হোক, গোটা বাঙালি তার জাতিসত্তাকে হারাইবে।’

অন্যদিকে কবি গোলাম মোস্তফার উর্দুর পক্ষে ওকালতির বিরুদ্ধে স্থানীয় কয়েকজনের মতো একই ধারায় সৈয়দ মুজতবা আলী অনেক তথ্য যুক্তিসহকারে বাংলা রাষ্ট্রভাষার যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন।

সবশেষে তার বক্তব্য মোক্ষম ভবিষ্যদ্বাণীর মতো : পূর্ব পাকিস্তানের অনিচ্ছা সত্ত্বেও যদি তার ঘাড়ে উর্দু চাপানো হয় তবে স্বভাবতই উর্দু ভাষাভাষী শুধু ভাষার জোরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে চেষ্টা করবেÑ ফলে জনসাধারণ একদিন বিদ্রোহ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।’ সৈয়দ সাহেব যা বুঝেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তা বুঝতে পারেননি।

একদিকে পাকিস্তানি মোহ, অন্যদিকে মাতৃভাষার প্রতি মমতাÑ এই দুইয়ের টানাপড়েনে ভুগেছে পাকিস্তানি বাঙালি মুসলমান সমাজ, যা অনেকটাই সুস্থ বাঁক নিয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর। তখন থেকে শুরু হয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার মুক্তিস্নানের প্রক্রিয়া। সূচনালগ্নের ওই টানাপড়েনের একটি চমকপ্রদ উদাহরণ ‘সওগাত’-এর মতো একটি প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদকীয়তে উর্দু রাষ্ট্রভাষাকে করার পক্ষে সমর্থন।

অবশ্য ওই সম্পাদকীয় লেখেন সাহিত্যিক মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী।

অন্যদিকে সাত চল্লিশের নভেম্বরেই পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ এবং বঙ্গভাষা প্রসার সমিতির সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয় (আজাদ)।

এ সময় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল হাই নম্র ভাষায় এবং অধ্যাপক মহীয়্যুদদীন সুস্পষ্ট দৃঢ় ভাষায় বাংলার প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। শেষোক্ত জনের ভাষায়, ‘পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রয়োগ করিতে বদ্ধপরিকর হইতে হইবে।’

রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক নিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত একটি জরিপের সাহায্য নিলে দেখা যাবে, এ সময় পরিসরে একমাত্র ছাত্রসমাজই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে একাট্টা সমর্থন জুগিয়ে গেছে। শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক এবং পেশাজীবীদের মধ্যে ছিল বিভাজিত সমর্থন। পক্ষে-বিপক্ষে উভয়মত। তবে গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতি সংগঠন সবগুলোই ছিল বাংলার পক্ষে।