logo
আপডেট : ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:৩৪
পাশে থাকা ভদ্রলোকটিও ভয়ংকর হতে পারে!
ইদ্রিস আলম হৃদয়

পাশে থাকা ভদ্রলোকটিও ভয়ংকর হতে পারে!

বেশভূষা দেখে বোঝার উপায় নেই। স্যুট-কোট, টাইপরা ভদ্রলোক। কখনো ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী। কখনো যাত্রী ও স্বামী-স্ত্রী সেজে কৌশলে টার্গেট ব্যক্তিদের পাশে বসে সখ্যতা গড়ে তোলেন। লক্ষ্য, বিশ্বাস অর্জন করা। পরে ভাব জমান। তারপর চেতনানাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য খাওয়ানোর। সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে চম্পট-এরা অজ্ঞান পার্টি। সম্প্রতি রাজধানীতে এ পার্টির তৎপরতা আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে। খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।


ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির তথ্যে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৩৫ জন। এর মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য মারাও গেছেন। আর চলতি মাসের মাত্র চার দিনে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছেন অন্তত ছয়জন।


এছাড়া অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পরে প্রতিদিনই খোয়া যাচ্ছে মানুষের টাকা-পয়সা। সর্বস্বান্ত হচ্ছেন অনেকেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির লোকজন খাদ্যদ্রব্য হিসেবে চা, কফি, জুস, ডাবের পানি, বরই, পান, রুমাল ও ক্রিম জাতীয় বিস্কুট ইতাদি ব্যবহার করে। ডিবি সূত্রে জানা যায়, কৌশল বদলাচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। অজ্ঞান করে ভিক্টিমের মোবাইল দিয়ে পরিবারের সদস্যদের ফোন করে বলা হয়, আপনার স্বজন সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন। আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। এখনই বিকাশে টাকা না পাঠালে বাঁচানো সম্ভব হবে না। টাকা নিয়ে ভিক্টিমের মোবাইল বন্ধ করে দেয়।


স¤প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া অজ্ঞান পার্টির এমন অভিনব কৌশলের কথা জানায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গ্রেপ্তার অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা পুলিশকে জানিয়েছে, ঢাকার বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল, বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিকে টার্গেট করে প্রথমে সখ্যতা গড়ে তোলা হয়। পরে তাদের দলের অন্য সদস্যরা ওই ব্যক্তিকে ট্যাবলেট মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য খেতে আমন্ত্রণ জানায়। টার্গেটকৃত ব্যক্তি রাজি হলে তাকে চেতনানাশক মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য খাওয়ানো হয় এবং বিশ্বাস অর্জনের জন্য নিজেরাও সাধারণ খাবার গ্রহণ করে। পরে সর্বস্ব নিয়ে সটকে পড়ে।


চেতনানাশকের প্রভাবে গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মীর আবদুল হান্নান মারা যান। তিনি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় যাওয়ার পথে ঢাকার কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েন।


জাহিদুল ইসলাম (২৮) গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শেরপুরে। সৌদি আরব থেকে স্ত্রীর জন্য স্বর্ণের গয়না, মা ও পরিবারের সবার জন্য উপহার নিয়ে আসলেও প্রিয়জনদের কারো হাতে তা তুলে দিতে পারেননি। বিমান থেকে নেমে বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সবই খুইয়েছেন। প্রায় ১৪ ঘণ্টা চিকিৎসার পর তার জ্ঞান ফিরে। জাহিদুলের স্ত্রী জান্নাতি খাতুন বলেন, গত ১৪ জানুয়ারি তার স্বামী বিমানযোগে ঢাকায় ফিরে উত্তরায় শাহ ফতেহ আলী নামের একটি বাসে উঠে বগুড়ায় আসার পথে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন। জাহিদুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বাসের চালক, সুপারভাইজার ও হেলপারকে জিজ্ঞাসা করলেই এই অজ্ঞান পার্টির সঙ্গে কারা জড়িত, তা বের হয়ে আসবে। নইলে তার মতো বিদেশ থেকে ফেরা লোকজন বারবার সর্বস্ব হারাবেন।


এছাড়াও গত দুই জানুয়ারি এক দিনে কুমিল্লার বরুড়া রাজগ্রামের বাসিন্দা জসীমউদ্দীন ও সৌদিপ্রবাসী ছেলেকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামিয়ে দেওয়ার পর একটি বাসে করে গ্রামের উদ্দেশে ফিরছিলেন। এরই মধ্যে বাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন তিনি। তার কাছ থেকে টাকা এবং স্যামসাং মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।


কুষ্টিয়ার সবুজ মিয়াকে গত মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে মতিঝিল নটর ডেম কলেজের সামনে বাসস্ট্যান্ড থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান তার ফুফাত ভাই রাকিবুল। তার কাছে থাকা মোবাইল ও ১৩ হাজার টাকা খোয়া গেছে বলে জানা যায়। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ৩২ বছরের রোকেয়া সুলতানা। সোনারগাঁও থেকে বাসে করে মেয়ে সিনহা আক্তারকে নিয়ে টিকা দিতে যাচ্ছিলেন জেলার ভবনাথপুর নতুন সেবা ক্লিনিকে। তার পাশের সিটে বসা এক নারী তাদের বরই খাওয়ান। তার কিছুক্ষণ পরে তারা অচেতন হয়ে পড়েন।


ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) বাচ্চু মিয়া বলেন, অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া রোগীর সংখ্যা আগে অনেকটা কম ছিল। তবে হঠাৎ করে গত মাস থেকে কিছুটা বেড়ে গেছে। গতমাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে আমাদের এপিবিএন পুলিশের এক উপ-সহকারী পরিদর্শক মারা গেছেন।


গত এক মাসে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে কতজন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এভাবে সঠিক তথ্য এই মুহূর্তে আমি দিতে পারছি না। কারণ আমাদের এখান থেকে ওয়াস করে মিটফোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে প্রায় ৩৫ জনের মতো হবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি) মিডিয়া কর্মকর্তা এডিসি হাফিজ আল আজাদ ভোরের আকাশকে বলেন, অজ্ঞান পার্টি গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান প্রতিনিয়ত অব্যহত রয়েছে। এদের ধরে আইনের আওতায় আনতে থানা পুলিশ তৎপর রয়েছেন।


অজ্ঞান পার্টি থেকে সচেতন থাকতে ভ্রমণপথে অপরিচিত কারো সঙ্গে ঘনিষ্ঠ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, রাস্তায় অপরিচিত কারো কাছ থেকে কোনো কিছু খাওয়া যাবে না। কোনো প্রকার ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে না নিয়ে স্থায়ী দোকান থেকে খাবার খেতে হবে।