নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার আশীর্বাদে নার্স বদলিবাণিজ্য করে মো. জামাল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ভুক্তভোগী নার্স, অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ দাবি করেছেন। তাদের অভিযোগের পর ভোরের আকাশের নিজস্ব অনুসন্ধানেও সত্যতা মিলেছে এ তথ্যের।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কুষ্টিয়া সদরের ইন্দিরা মোড়ে স্ত্রী শাকিরুন নেসার নামে কিনেছেন ৪ কাঠা জমি। এর দাম ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টাকা। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কমলাপুরের নিজ গ্রাম দুধকুমড়ায় প্রায় ২৭ থেকে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছেন একটি দোতলা আলিশান বাড়ি। এর পাশেই ‘বিশ্বাসবাড়ী’ নামে আরেকটি একতলা পাকাবাড়ি নির্মাণেও বেশির ভাগ টাকা জামাল দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসী। তিনি ২০২১ সালের ১ জুলাই রাজধানীতে ‘মেসার্স জামাল এন্টারপ্রাইজ’ নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেন। যাত্রাবাড়ীর শেখদী স্কুল রোডের ৩৭/২৩ নং হোল্ডিংয়ে গড়ে ওঠা তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নং -ট্রেড/ডিএসসিসি/০২০৬৪৪২০২১।
ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে তার আটটি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয়টি অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৭৬ লাখ টাকা জমা করার নথি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কমপ্লেক্স শাখায় তার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০৮১। বিশেষ কোনো ব্যবসা না থাকলেও এই সঞ্চয়ী হিসাবটিতে সারা দেশ থেকেই টাকা জমা পড়ে। গত ২০২১ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসেই এই একটি হিসাবে ২১টি জেলার ৪৩টির বেশি শাখা থেকে ৬৩ বার টাকা জমা পড়েছে। ২০২১ সালের ২৬ জুলাই খোলা হলেও উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অ্যাকাউন্টটিতে ১ কোটি ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ১১৮ টাকার বেশি লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে এই অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করা হয়েছে ১ কোটি ৯ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫৪ টাকা। সঞ্চিত রয়েছে ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬৪ টাকা।
জামাল উদ্দিনের যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া শাখার কৃষি ব্যাংকে রয়েছে পৃথক অ্যাকাউন্ট। যার সঞ্চয়ী হিসাব ৪১২৩০৩১০০৫০৯৭০। এতে ২০২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৭ লাখ ৮৮ হাজার ২২২ টাকা জমা পড়েছে এবং উত্তোলন করা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩৯ টাকা।
জামালের স্ত্রী শাকিরুন নেসা পেশায় গৃহবধূ। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সোনালী ব্যাংক শাখায় শাকিরুন নেসার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৩০১৬৩০১০১৩০১৯। এই অ্যাকাউন্টটি ২০২১ সালে ১৮ মে খোলা হয়। এই হিসাব নম্বরেও লেনদেন হয়েছে ৭২ লাখ ৮২ হাজার ৭১ টাকা। সেখান থেকে ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫৫ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ৩০ জানুয়ারি এ অ্যাকাউন্টে সঞ্চিতি ছিল ২ লাখ ৪২ হাজার ২১৬ টাকা।
জামালের আরেকটি অ্যাকাউন্ট আছে রাজধানীর শনির আখড়া শাখার কৃষি ব্যাংকে। যার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ১৯১৪০৩১১০৫৪৬৩৫। এখানে ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ লক্ষাধিক টাকা জমা আছে জামালের।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের দনিয়া শাখায় সূচনা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি অ্যাকাউন্ট আছে। এটিও জামাল উদ্দিনের অ্যাকাউন্ট। ১১৯১১০১৪৫০১ এই হিসাব নম্বরটিতে জমা পড়ে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭৩ টাকা। এই অ্যাকাউন্ট থেকে ২ কোটি ৬৩ লাখ ১০ হাজার ২২৫ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক শাখায় রয়েছে জামালের আরো একটি অ্যাকাউন্ট। ১৬৮১১০০০২২১০১ হিসাব নম্বরটিতে ২০২২ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৪ লাখ ১০ হাজার ৯৪০ টাকা জমা পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জামাল এসব কাজে ০১৯৩৮৭৩১৬৭৬ এই নম্বরটি ব্যবহার করতেন। তবে এটি তার নামে রেজিস্ট্রিশন করা নয়। বদলি সংক্রান্ত সব ধরনের কাজে কথোপকথন এই নম্বর থেকেই করতেন তিনি। তবে বর্তমানে নম্বরটি বন্ধ রয়েছে। তিনি ০১৭১৬৩৯০৯৫৭ নম্বরের আরেকটি মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করেন; সেটিও বন্ধ পাওয়া গেছে।
একটি সূত্র দাবি করেছে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত এই হিসাব নম্বর গুলোর লেনদেন দেখলে জামালের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্যের সব তথ্য পাওয়া যাবে। যার দৃশ্যমান কোনো আয় নেই তার অ্যাকাউন্টে কিভাবে কোটি কোটি টাকা এলো তা অবশ্যই তদন্ত করা উচিত।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে এমন আলোচিত বদলি বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তারকে একাধিকবার ফোন করা হয়। তবে তিনি ফোন ধরেননি।