logo
আপডেট : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:২২
ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বিতরণে চরম ভোগান্তি
রাজন ভট্টাচার্য

ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বিতরণে চরম ভোগান্তি

তিন বছর ধরে থেমে আছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া। কার্ড (স্মার্টকার্ড) সংকটের কারণে নতুন বা পুরোনো কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্ট করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে ১৩ লাখের বেশি আবেদন জমা পড়েছে বিআরটিএ দপ্তরে। বারবার তারিখ দিয়েও গ্রাহকদের কার্ড সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এই পরিবহণ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অভিযোগ আছে তিন বছর ধরে একটানা অপেক্ষায় থেকে একটি কার্ডও পাননি কেউ কেউ। সব মিলিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ড বিতরণে ভোগান্তি এখন চরমে পৌঁছেছে।


যদিও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী চার মাসের মধ্যে সংকটের সমাধান হবে। তবে পরিবহণসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই এই ভোগান্তির জন্ম। এর দায়দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, লাইসেন্সের কার্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত দুই বছর আগে নতুন টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর প্রয়োজন ছিল। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়া ও নতুন লাইসেন্স না পাওয়া পরিবহণ চালকদের রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মামলা দিচ্ছে। অথচ বিআরটিএ এ ব্যাপারে নতুন কোনো নির্দেশনা জারি করছে না।


জানা গেছে, তিনবার স্মার্ট কার্ডের জন্য টেন্ডার আহ্বান করেছে বিআরটিএ। প্রতিবারই নানা জটিলতায় টেন্ডার বাতিল হয়েছে। চতুর্থবারের টেন্ডারে মাদ্রাজ সিকিউরিটিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেলেও নানা জটিলতায় কার্ড ছাপাতে যেতে পারছে না। তাই পরিস্থিতি মোবাকিলায় সেনাবাহিনীর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে কার্ড ছাপানোর চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি।


জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, পেন্ডিং লাইসেন্স সরবরাহে আমরা বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিকে কাজ দিয়েছি। আশা করি আগামী তিন বা চার মাসের মধ্যে সবাই লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। এভাবে তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তাদের এখন যে প্রোডাকশন আছে, তা আরো বাড়বে।


তিন মাসের মধ্যে কার্ড পেলে বিআরটিএ থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সময় দেওয়া হচ্ছে কেন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘টাইম বাড়িয়ে দিলে তো সমস্যা নেই। কারণ কার সিরিয়াল কখন আসে, তার কোনো ঠিক নাই। তাই সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তবে তারা তার আগেই স্মার্টকার্ড পেয়ে যাবেন। একটু দেরি হলেও যেন আবার আসতে না হয়, সে জন্যই বাড়তি সময় দেওয়া।


বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৩ লাখ লাইসেন্স প্রার্থী আছেন এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আবেদনকারীদের বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালের আবেদনকারীরাই এখনো লাইসেন্স পাননি। তাই যারা ২০২১ সালে আবেদন করেছেন, তাদের সিরিয়াল আসতে কত সময় লাগবে তা কেউ জানে না।


জাল, অবৈধ বা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবহারের প্রবণতা প্রতিরোধে ২০১১ সাল থেকে ইলেকট্রনিক চিপযুক্ত ডিজিটাল স্মার্টকার্ড-সংবলিত ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যবস্থা চালু করা হয়।


রাজধানীর মানুষের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য তিনটি কার্যালয় রয়েছে। একটি মীরপুর, অন্যটি উত্তরা আরেকটি ইকুরিয়া। মিরপুরের বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ গ্রাহকই লাইসেন্স না পেয়ে রসিদে সময় বাড়িয়ে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন। একই চিত্র দেখা গেছে অন্যসব কার্যালয়গুলোতেও। এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গ্রাহকরা।


প্রসেনজিৎ পাল নামের এক ব্যক্তি উত্তরা কার্যালয়ে বলেন, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা হয়েছে প্রায় দুই বছর। ইতোমধ্যে তিনটি তারিখ পরিবর্তন হলেও কার্ড পাইনি। এ নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। রাস্তায় লাইসেন্স ছাড়া বের হলে পুলিশ মামলা দেয়, হয়রানির শিকার হতে হয়। বিআরটিএ তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে না।


মিনহাজ জানান, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে হালকা যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে এখনো পাননি। তিনি বলেন, ‘চারবার এসেও লাইসেন্স পাইনি। বিল্লাল নামের আরেকজন জানালেন, তাকে কয়েকদফা সময় দেয়ার পর নতুন করে আবার সময় দেওয়া হয়েছে ২৯ সেপ্টেম্বর। কারো কারো অভিযোগ অক্টোবর বা নভেম্বর পর্যন্ত সময় চেয়েছে বিআরটিএ।


জানা গেছে, ২০১৬ সালে লাইসেন্স দিতে টাইগার আইটি লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ১৫ লাখ লাইসেন্স সরবরাহের চুক্তি করে বিআরটিএ। টাইগার আইটির সঙ্গে পাঁচ বছরের যে চুক্তি ছিল, তা শেষ হয়েছে ২০২০ সালের শুরুতে।


শেষ দুই বছর যে পরিমাণে আবেদন জমা হয়েছে, তার তথ্য সংরক্ষিত রয়েছে টাইগার আইটির তথ্যভান্ডারে। ফিঙ্গার স্ক্যানিংও হয়েছে এ কোম্পানির আওতায়, তবে শেষ সময়ে লাইসেন্স ছাপাতে বাড়তি অর্থ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি। তাতে বিআরটিএ সম্মতি দেয়নি; বিষয়টি সুরাহাও হয়নি। চুক্তি শেষ হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে বন্ধ করে রেখেছে সার্ভার।


এ কোম্পানির সঙ্গে কোনো সমাধানে না গিয়ে ৪০ লাখ কার্ড ছাপাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ‘মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেড’-এর সঙ্গে চুক্তিতে যায় বিআরটিএ, তবে জটিলতা থাকায় আগের প্রতিষ্ঠানের (টাইগার আইটির) কাজ করতে রাজি নয় মাদ্রাজ প্রিন্টিং। ২০২০ সালের ২৯ জুলাই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে ১২০ কোটি টাকার চুক্তি হয়, তবে কাজ শুরু বা লাইসেন্স ছাপানো শুরু হয়েছে আরো সাত মাস পর।


তবে আন্তর্জাতিক এই টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিপাকে বিআরটিএ। কারণ হিসেবে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক টেন্ডারের ক্ষেত্রে নানারকম শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান যদি সেসব শর্ত যথাযথভাবে পূরণ করতে না পারে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার বাতিল হয়। আবার কোনো প্রতিষ্ঠান যদি বিশে^র কোথাও কালো তালিকাভুক্ত থাকে সে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া যাবে না। এসব জটিলতায় মূলত সময় ক্ষেপণ করেছে বিআরটিএ।


২০১৮ সালের আগস্টে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলনের পর লাইসেন্সের আবেদনকারীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের আগেই লাইসেন্স ফুরিয়ে যায়। ছাপানো ও কার্ড সরবরাহ নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। পলিকারবোনেটেড এসব কার্ড বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।


এ অবস্থায় জমে যাওয়া কার্ড সরবরাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির (বিএমটিএফ) সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি কার্ড ছাপানোর কাজ শুরু করেছে। ছয় মাসের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে ১২ লাখ লাইসেন্স সরবরাহ করার কথা রয়েছে।


গ্রাহকদের অভিযোগ নতুন আর পুরাতন সব লাইসেন্স প্রক্রিয়াতেই ভোগান্তির চিত্র একই রকম। তবে সবাই দ্রæত সময়ের মধ্যে সংকট সমাধানের দাবি জানান।


জানতে চাইলে বিআরটিএ সাবেক চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান খান বলেন, বড় বড় টেন্ডারের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষ হওয়ার অন্তত দুই বছর আগে নতুন করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিআরটিএ গ্রাহক সংখ্যা অনেক বেশি। কোনো কারণে কাজ থেমে গেলে গ্রাহক ভোগান্তি বাড়ে। তা ছাড়া টেন্ডার দিলেই যে কাজ শুরু করা যাবে তা সঠিক নয়। অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সব শর্ত না মানে কিংবা আইনের ব্যত্যয় হয় তাহলে আবারো রি-টেন্ডার করতে সময় লাগে। তাই আগেভাগে বিআরটিএ প্রস্তুতি না নেয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রক্রিয়া আটকে গেছে। ফলে গ্রাহকদের দুর্ভোগ বাড়ছে।


সড়ক পরিবহণ সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, আমাদের অনেক চালক দিনের পর দিন ঘুরেও লাইসেন্স পাচ্ছে না। অথচ কবে এই সমস্যার সমাধান হবে তা বিআরটিএ কর্তৃপক্ষও সঠিক বলতে পরাছে না।
সড়ক পরিবহণ শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন বলেন, বিকল্পভাবে কিছু কার্ড ছাপিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বিআরটিএ। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী যদি কার্ড সরবরাহ নিশ্চিত করা না যায় তাহলে জনদুর্ভোগ কমবে না। আমরা বারবার বিআরটিএকে বলে আসছি দ্রæত যেন সমস্যার সমাধান হয়।