logo
আপডেট : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৫১
নিঃসঙ্গ প্রবীণদের দুঃখময় জীবন

নিঃসঙ্গ প্রবীণদের দুঃখময় জীবন

সম্প্রতি জাপানে একটি অবাক করার মতো ঘটনা সামনে এসেছে। জাপানের অধিকাংশ বয়স্ক মানুষ ছোটখাটো অপরাধ করছেন জেলে যাবার জন্য! তাদের উদ্দেশ্য জেলে বসবাস করা!

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বাস জাপানে। দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, কয়েক বছরের ব্যবধানে জাপানের কারাগারগুলোতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বয়স্ক আসামির সংখ্যা বেড়ে গেছে। বিস্মিত হওয়ার মতো ব্যাপার হলো, এই আসামিরা দণ্ডিত হচ্ছেন ইচ্ছাকৃতভাবে। ছাড়া পেলে তারা আবার একই অপরাধ করছেন। জেলে যাচ্ছেন; ছাড়া পেলে আবার একই ধরনের অপরাধ করছেন। অবস্থা এ রকম, কারাগারগুলোতে আসামিদের প্রতি ৫ জনে ১ জন বয়স্ক ব্যক্তি। কোনো কোনো কারাগারে প্রতি ১০ জনে ৯ জন! সম্প্রতি সিএনবিসি’র একটি প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, জাপানের বয়স্ক জনগণ প্রতিনিয়ত কারাগারের জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে চলেছেন। তাদের অধিকাংশেরই আর্থিক সমস্যা নেই। তারা কারাগার জীবনের যে দিকটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন তা হলো- ‘সঙ্গী লাভের উপায়’।


জাপানের প্রবীণদের এ ঘটনা অন্যান্য দেশে না ঘটলেও বিশ^ব্যাপী ‘প্রবীণ ও জরা সমস্যা’কে অস্বীকার করার উপায় নেই। আমাদের দেশে প্রবীণরা জেলে যেতে চাচ্ছেন না বটে, তবে তারা নিঃসঙ্গ থাকতে থাকতে অসহায়বোধ করছেন। এই অসহায়ত্ব থেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তারা আত্মহত্যা পর্যন্ত করছেন। নায়ক রিয়াজের শ^শুর মহসিন খানের আত্মহত্যা সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সারাদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ধানমন্ডিতে আরেকজন ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। তারপরও আমরা প্রবীণদের সমস্যা কেউ বুঝতে চেষ্টা করছি বলে মনে হয় না।


হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট রিপোর্ট ২০১৫ অনুসারে, বিশে^ প্রায় ৯০১ মিলিয়ন প্রবীণ মানুষের বসবাস। ২০৩০ সালে এ সংখ্যা হবে ১.৪ বিলিয়ন। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হবে দুই বিলিয়ন, যা তখনকার মোট জনসংখ্যার ২১.৫ শতাংশ। স্বভাবতই থেমে নেই বাংলাদেশের প্রবীণ মানুষের সংখ্যাও। বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও জরাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন। ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণদের এই সংখ্যা হবে প্রায় দুই কোটি। ২০৫০ সালে হবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি, ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। ২০৫০ সালের দিকে এদেশের ২০ শতাংশ নাগরিক প্রবীণ হবেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, আমাদের দেশের প্রবীণদের প্রধান সমস্যা হলো দরিদ্র ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। শরীরবৃত্তীয় কারণে প্রবীণ বয়সে কর্মক্ষমতা লোপ পায়। চাকরিজীবীরা অবসরে চলে যান। অন্যান্য শ্রমজীবীরাও ধীরে ধীরে তাদের কর্মপরিধি গুটিয়ে ফেলেন। তাই একটা সময় তাদের উপার্জনের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। বার্ধক্য ও দরিদ্রতায় আক্রান্ত হয়ে বেশিরভাগ প্রবীণ কাহিল হয়ে পড়েন। সম্প্রতি একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণই দরিদ্র এবং শতকরা ৫৮ ভাগ প্রবীণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই। গবেষণা মতে, ষাটোর্ধ্ব প্রবীণের ৪৫ শতাংশ কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। ১০ থেকে ১১ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভোগেন।


অপ্রিয় সত্য হলো, বাংলাদেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠী ঝুঁকির মধ্যে আছে। সাম্প্রতিক বিভিন্ন রিপোর্ট-সমীক্ষায় প্রবীণদের জীবন-মানের করুণ চিত্র ওঠে এসেছে। নিঃসঙ্গ প্রবীণ ব্যক্তি চার দেয়ালের মাঝে একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যান প্রতিদিনই। সঙ্গীহীন প্রতিটি দিনই তার কাছে মৃত্যুর সমান। মৃত্যুর প্রহর গুনে তার সময় কাটে। দিনের আলোও যেন তার কাছে রাতের নিকষ অন্ধকার! এ রকম বহু প্রবীণের মৃত্যু, হত্যা কিংবা আত্মহত্যার ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনামে ওঠে আসে মাঝেমধ্যেই। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত নিঃসঙ্গ প্রবীণদের মৃত্যুর সংবাদগুলো সবাইকে ব্যথিত করেছে। এসব মৃত্যু ‘নিঃসঙ্গ ও একাকীত্বের চরম খেসারত’। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পরিবার-আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ শেষ বয়সে ‘অনাকাক্সিক্ষত পরিবেশে’ মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা কিংবা হত্যার শিকারে পরিণত হওয়া এসব মানুষের শেষ বয়সের নিঃসঙ্গতার গল্পগুলো আমাদের চোখ ভিজিয়ে দেয়।


গেল বুধবারের ঘটনা দেশবাসীকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে। রাজধানী ঢাকার বাসায় সম্পূর্ণ একা বসবাস করা মহসীন খানের আত্মহত্যার ঘটনা কাঁদিয়েছে সবাইকে। নিঃসঙ্গ জীবনের আক্ষেপ নিয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন প্রবীণ মহসীন খান। আত্মহত্যার আগে ১৬ মিনিটের ফেসবুক লাইভে একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে মহসীন খানের বলে যাওয়া কথাগুলো দেশবাসীকে নাড়া দিয়ে গেছে। এ ঘটনা চরম উদ্বেগের। প্রবীণদের এ রকম অসহায় ও একা হয়ে পড়াটা নিদারুণ অনাকাক্সিক্ষত। সম্প্রতি এক বৃদ্ধ নারীকে গৃহপরিচারিকার বেধড়ক পিটুনি এবং বাসায় লুটপাটের ঘটনা সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। মুমূর্ষু অবস্থায় ওই বৃদ্ধ নারীকে উদ্ধার করা হয়। কিছুদিন আগের ঘটনা। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইদা গাফফারকে মাত্র দশ হাজার টাকার জন্য এক রাজমিস্ত্রির হাতে জীবন দিতে হয়েছে! অধ্যাপক সাইদা প্রবীণ বয়সে নিজেই বাড়ি নির্মাণের তদারকি করছিলেন। নির্মাণশ্রমিক তার একাকীত্বের সুযোগে টাকা পয়সা লুটে নিয়ে তাকে হত্যা করে লাশ গুম করে। প্রবাসী মেয়ে ফোনে না পেয়ে আত্মীয়দের জানালে গাজীপুরের কাশিমপুরে একটি ঝোঁপের মধ্য থেকে পুলিশ তার লাশটি উদ্ধার করে।


গত বছর নিঃসঙ্গতার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়ে প্রবাসে থাকায় রাজধানীর উত্তরার ১৮নং সেক্টরে অবস্থিত রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রজেক্টের একটি অ্যাপার্টমেন্টে তিনি একাকী বসবাস করতেন। ফোনে না পেয়ে প্রতিবেশীরা পরদিন দরজা ভেঙে তার লাশ উদ্ধার করেন। এর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বয়স্ক মাহফুজা চৌধুরী পারভীনকে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের নিজ বাসায় দু’জন গৃহকর্মী শ^াসরোধ করে হত্যা করে। মাহফুজা চৌধুরী ইডেন কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন। দুই ছেলে প্রবাসে থাকায় স্বামীর সাথে তিনি বসবাস করতেন। স্বামী বাড়ির বাইরে থাকায় এই প্রবীণ মানুষটি হত্যাকারীদের শিকারে পরিণত হন।
একাকীত্বের বলী হয়ে প্রবীণদের এ রকম করুণ মৃত্যুর চিত্র বেশ লম্বা। বহু প্রবীণ আছেন যারা সন্তান-সন্ততি বা পরিবার থাকার পরও একাকী বসবাসে বাধ্য হচ্ছেন। শেষ বয়সে অনেকের স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। একটু সাহচার্য ও ভালোবাসা জুটলে হয়তোবা তারা আরো বহু বছর পার করতে পারতেন এই জীবনসংসারে।
বর্তমান সমাজব্যবস্থায় একটা বাজে প্রবণতা সর্বত্র। ছোট পরিবারের দোহাই দিয়ে কিংবা বিলাসী জীবনের হাতছানিতে বয়স্ক মানুষগুলোকে একপাশে ফেলা রাখা হয়! অথচ অসহায় প্রবীণদের কল্যাণে আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। কেননা, বার্ধক্য প্রতিটি মানুষের জন্য অবধারিত। আজকের নবীনই আগামী সময়ের প্রবীণ। প্রবীণদের সুরক্ষা ও কল্যাণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা সবার নৈতিক দায়িত্ব। প্রবীণদের জন্য ভালো বসবাসের স্থান, পুষ্টিকর খাবার-দাবার, সুচিকিৎসা, বিনোদন, শরীরচর্চার ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। সব থেকে জরুরি হলো তাদরেকে ‘যথেষ্ট সময় দেওয়া’। এটা গবেষণায় প্রমাণিত, প্রবীণ বয়সে মানুষ ব্যাপকভাবে ‘সাহচার্য’ কামনা করে। এটাই তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে কার্যকর টনিক হিসেবে কাজে দেয়।


বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে প্রবীণবান্ধব। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে প্রবীণদের বিষয়ে বলা হয়েছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এ মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রবীণবিষয়ক বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রবীণেরা বিপদাপন্ন, দারিদ্র্যের শিকার ও একাকিত্বে জর্জরিত। সরকারি সেবা কার্যক্রমে প্রবীণদের প্রবেশগম্যতা সীমিত। প্রবীণেরা সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারের বিভিন্ন পর্যায়ে বৈষম্যের শিকার। এর কারণ হলো মানুষের মর্যাদা, সম্মান ও ভালোবাসা প্রাপ্তির মানদণ্ড হিসেবে আয়ের বয়সসীমাকে মনে করা। এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করাটা সময়ের দাবি। বয়স্কদের জন্য প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করাটাও জরুরি। তাদের জন্য সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার। আমরা প্রবীণদের জন্য সর্বজনীন সামাজিক পেনশনের কথাও ভাবতে পারি। সর্বোপরি, আমাদের নিজের ভবিষ্যৎ প্রবীণ জীবন সুরক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা উচিত।


পৃথিবী, মানুষ, সমাজ ও অর্থনীতি পরিবর্তিত হতে থাকবে। এ পরিবর্তনের ধারা সময়ের নিজস্ব গতিতে বহমান। কালের নিয়মে সবাইকেই একটা সময়ে প্রবীণ হতে হবে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম এটাই। প্রবীণকূলের চাওয়াগুলোও তাই প্রাকৃতিকভাবে যৎসামান্য। একজন প্রবীণ শুধু একটুখানি সম্মান প্রত্যাশা করেন। তিনি চান তার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা ও অবদানকে সবাই স্বীকৃতি দিক। প্রবীণের কামনা, সবাই একটুখানি তার খোঁজখবর রাখুক। প্রবীণদেরকে আর্থিক সক্ষমতার মাপকাঠিতে বিচার করাটা অমানবিক। প্রবীণদের মূল্যায়নের মানদণ্ড হওয়া উচিত এ রকম ‘দুর্যোগে মোরা নই দিশাহীন, সঙ্গে আছেন অভিজ্ঞ প্রবীণ’।


লেখক : সাংবাদিক