logo
আপডেট : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:০৫
খুলনা প্রিন্টিংয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

খুলনা প্রিন্টিংয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি খুলনা পাওয়ারের ভবিষ্যৎ। দিন দিন দায়-দেনায় ডুবে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ভারী হচ্ছে লোকসান। এরই জেরে শেয়ার হোল্ডাররদের কোনো ধরনের রিটার্ন দিতে ব্যর্থ হচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে কোম্পানির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে কোম্পানির চেয়ারম্যানও লাপাত্তা। সবমিলে কোম্পানির অবস্থা নাজুক। এতে বেকায়দায় পড়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

কোম্পানির আর্থিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দিন যত যাচ্ছে ততই ভারী হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান। প্রাপ্ততথ্য মতে, ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানের লোকসান হয়েছে ১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা। পরের বছর তা কমে লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর পরের বছর অর্থাৎ, ২০২১ সালে লোকসান কয়েক গুণ বেড়ে যায়। এ বছর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে যে পরিমাণ লোকসান দেখা যাচ্ছে তাতে বছর শেষে লোকসান আগের চেয়ে (২০২১) কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সম্প্রতি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের চলতি হিসাব বছরের অর্ধবার্ষিক (জুলাই থেকে ডিসেম্বর, ২০২১) এবং দ্বিতীয় প্রান্তিক (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর, (২০২১) আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, আগের বছরের তুলনায় কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) ২ হাজার ৮৯০ শতাংশ বেড়েছে।

কোম্পানিটির চলতি হিসাব বছরের ছয় মাসে শেয়ারপ্রতি লোকসান (ইপিএস) হয়েছে ২ দশমিক ৯৯ টাকা। আগের হিসাব বছরের একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল শূন্য দশমিক ১০ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানিটির লোকসান ২ দশমিক ৮৯ টাকা বা ২ হাজার ৮৯০ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে প্রতিষ্ঠানের চলতি হিসাব বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১ দশমিক ৯৬ টাকা। আগের হিসাব বছরে একই সময়ে শেয়ারপ্রতি লোকসান ছিল শূন্য দশমিক শূন্য ২ টাকা। সে হিসেবে কোম্পানিটির লোকসান হয়েছে ১ দশমিক ৯৪ টাকা বা ৯ হাজার ৭০০ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে কোম্পানির শেয়ারপ্রতি সম্পদের পরিমাণ।

২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর কোম্পানিটির ঋণাত্মক শেয়ার প্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভিপিএস) দাঁড়িয়েছে ১ টাকায় ৭৬ টাকায়। এর মধ্যে চেয়ারম্যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এ কোম্পানির শেয়ারধারীরা। বর্তমানে তিনি পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

তথ্যমতে, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন এবং তার সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব বর্তমানে জব্দ রয়েছে। এর সুরাহ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ থাকবে বলে জানায় কোম্পানি কর্র্তৃপক্ষ।

ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চার দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। আমেরিকা, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। পাচার করা বিপুল অঙ্কের অর্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাসাদ গড়েছেন।

আমজাদ হোসেনের নামে দুদকে আরো ৮২৯ কোটি টাকা জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। এর আগে আরো ৪৩০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। সবমিলিয়ে তার জালিয়াতি করা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর আমজাদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের (ফ্রিজ) আদেশ দেন আদালত। পরবর্তী সময়ে তিনি দেশ ছেড়ে পালান।

বিয়ষটি নিয়ে কথা বললে প্রতিষ্ঠানটির সচিব মো. মিলান খান ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে কোম্পানির উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। চেয়ারম্যানের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ থাকায় আমরা প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ রেখেছি।

কবে নাগাদ আবার উৎপাদন শুরু হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফ্রিজ থাকা অ্যাকাউন্টের সুরাহ না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদনে যাওয়া সম্ভব হবে না।

এদিকে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নাজুক হওয়ার কারণে ২০২১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৬ টাকা ১২ পয়সা (লোকসান)। ৩০ জুন, ২০২১ তারিখে শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি) দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ২৩ পয়সা।

কাগজ ও মুদ্রণশিল্প খাতের কোম্পানিটি ২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়ে বর্তমানে কাগজে কলমে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে লেনদেন হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে ২০২১ সালে লভ্যাংশ না দেওয়ায় নিয়মানুযায়ী ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে নেমে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।

১০০ কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধনের এই কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে ৫৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। একইভাবে পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ শেয়ার। বাকি ১ দশমিক ৬৮ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা।

উল্লেখ্য, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে অনুমোদন ছাড়া বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতার অতিরিক্ত কাঁচামাল সংরক্ষণ করায় কেপিপিএলের বিরুদ্ধে ২৭১ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির অভিযোগ তোলে এনবিআর। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল কোম্পানিকে জরিমানা করে রাজস্ব আহরণের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি। জরিমানা পরিশোধ না করলে ওই বছরের ২৫ আগস্ট থেকে খুলনায় প্রতিষ্ঠানটির ছয়টি গুদাম সিলগালা করে এনবিআর।

তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে এনবিআরের জরিমানার আদেশ ও সিলগালার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করলে ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি এনবিআরের পদক্ষেপকে অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। ২০১৪ সালে কোম্পানিটি যখন পুঁজিবাজারে আসে তখনো তাদের বিএসইসিতে ভুল তথ্য উপস্থাপন করার নজির রয়েছে।