logo
আপডেট : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:২৭
বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগী
খোঁজ রাখে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
নিখিল মানখিন

খোঁজ রাখে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

প্রতীকী ছবি

বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের খোঁজখবর নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনা রোগী ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গঠন করা হয়েছে করোনাবিষয়ক সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আক্রান্তদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য অধিদপ্তরের চিকিৎসক টিম রয়েছে। আক্রান্তদের আইসোলেশন, তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন, বাসায় থাকলে তার চিকিৎসাপ্রদানসহ রোগী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অধিদপ্তরের চিকিৎসকদের।

বর্তমানে আক্রান্তদের ৯৯ শতাংশ বাসায় চিকিৎসাধীন থাকায় বাসার রোগী ব্যবস্থাপনার বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। বাসার করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা যথাযথভাবে মনিটরিং না করলে মৃত্যুর হার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সংবাদকর্মী রুদ্র মিজান করোনা পজিটিভ শনাক্ত হন গত ২৭ জানুয়ারি। তিনি বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো ফোন কল পাননি তিনি।

রাজধানীর মগবাজারের বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দেয়ালঘেঁষে ফুটপাতে চা বিক্রি করেন মো. মোফাজ্জল (৩৮)।

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘গত ৫ জানুয়ারি করোনা পজিটিভ হওয়ার রিপোর্ট মেসেজ আসে মোবাইলে। আমার শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। স্বাদ-গন্ধ কিছুই বুঝতে পারিনি। শরীর দুর্বল হয়ে পড়লে মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হয়েছি। পজিটিভ হওয়ার খবর পাওয়ার পর বাসায় ৬ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। কিন্তু অধিদপ্তরের কোনো ফোনকল পাইনি।’

গত ১৪ জানুয়ারি করোনা পজিটিভ শনাক্ত হয় নাসরীন জাহানের। একে একে করোনাতে সংক্রমিত হন তার পরিবারের আরো তিনজন। মোট চারজনের মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মাত্র একজনকে টেলিফোন করা হয়েছে। জানতে চাওয়া হয়েছে, তিনি কেমন আছেন, টিকা নিয়েছেন কি না। এই পরিবারের বাকি তিন সদস্য অধিদপ্তর থেকে ফোন পাননি।

আবু হাসান করোনায় আক্রান্ত হন ১১ জানুয়ারি। তার স্ত্রী জোহরা শিউলিও তারপর দিন আক্রান্ত হন। তারাও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোনকল পাননি। গণমাধ্যমকর্মী ইশরাত জাহান ঊর্মি করোনাতে আক্রান্ত হন গত ২২ জানুয়ারি।

আরেক গণমাধ্যমকর্মী শেরিফ আল সায়ার করোনার পজিটিভ রিপোর্ট পান ১১ জানুয়ারি। নুরেম মাহপারা প্রাপ্তি পজিটিভ হন ১৮ জানুয়ারি। ঊর্মি, শেরিফ কিংবা প্রাপ্তি তারা কেউ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোনকল পাননি। শহর ও গ্রাম-উভয় এলাকাতেই বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের খবর না নেওয়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে।

বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের বাড়তি সতর্কতা নেওয়াসহ চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

তারা বলছেন, করোনা ভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় এবং ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপট রয়ে গেছে। দৃশ্যমানভাবে সুস্থ মনে হওয়ার পরও যেকোনো মুহূর্তেই জীবনের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে করোনার ওমিক্রন ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মিলিত আক্রমণ।

দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজস্টি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, বাসায় চিকিৎসাধীন রোগীদের মনিটরিং করতে হবে। করোনা পরীক্ষার পর যদি পজিটিভ রেজাল্ট আসে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে আইসোলেশনে নিয়ে যেতে হবে।

যার পজিটিভ তার সংস্পর্শে যারা আসবে তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যেতে হবে। যাদের শরীরে শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য লক্ষণ থাকবে তাদের অবশ্যই হাসপাতালে পাঠাতে হবে। প্রয়োজনে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে এ জন্য একটি কমিটি করার কথা বলা হয়েছিল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে প্রধান করে একটি কমিটি থাকবে। সেখানে আরো থাকবেন ধর্মীয় প্রতিনিধি, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা বাসায় যেসব রোগী থাকছেন তাদের চিকিৎসা, আইসোলেশন হচ্ছে কি না সব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করবেন তারা।

আর অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা বাসায় চিকিৎসাধীন করোনা রোগীদের অনলাইনে চিকিৎসা পরামর্শ দিবেন। কিন্তু এটা কেউ করছে না, ভীষণভাবে অব্যবস্থাপনা হচ্ছে চারিদিকে।

ডা. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, স্থানীয় কমিটি দরকার হলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে, বাসায় থাকলে তার ব্যবস্থাপনা করবে, এমনকি বাসায় কেউ না থাকলে পরিবারের জন্য বাজার পর্যন্ত করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এসবের কিছুই হয়নি।

মহামারি নিয়ন্ত্রণে রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়, সেই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু তার বাস্তবচিত্র আমরা গত দুই বছরেও দেখতে পাইনি।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, করোনা ভাইরাস শনাক্তরণ ও হাসপাতালে যাওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা ভালো লক্ষণ না। অধিকাংশ রোগীরই হাসপাতালে যেতে হয় না।

যারা বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা বাসায় থাকলেও একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। না হলে তারা বুঝতে পারবেন না অবস্থার অবনতি হচ্ছে কি না। প্রতিটি রোগীর ফলো-আপ দরকার। সেই সঙ্গে যারা উপসর্গহীন রয়েছেন তাদের পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করা। রোগী ব্যবস্থাপনা এবং রোগী শনাক্তে সাহায্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত পাবলিক হেলথ উপদেষ্টা কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, অধিদপ্তর থেকে যে একজনকে ফোন করে খোঁজ নেওয়া হয়েছে সেটাই অনেক, তার অনেক ভাগ্য যে তিনি ফোন কল পেয়েছেন। ওমিক্রনের ঊর্ধ্বগতিতে প্রায় ৯৯ শতাংশই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, যেহেতু সবার ক্ষেত্রে এটা ডেল্টার মতো জটিলতা তৈরি করছে না।

আর হাসপাতালের বাইরের রোগীদের কী অবস্থা, তার কোনো সেবা দরকার রয়েছে কিনা, তাকে কোনো উপদেশ দেওয়ার দরকার রয়েছে কিনা-এটা অবশ্যই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দেখতে হবে, এটা তার দায়িত্ব, বলেন অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডীন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বাসায় অবস্থানরত করোনা রোগীদের অনেকেই কোথায়, কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং শরীরের অবস্থা কোন পর্যায়ে গেলে রোগীকে কী ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে, সেই সম্পর্কে ধারণা রাখেন না।

শারীরিক জটিলতা বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সঙ্গে যোযাযোগ করে করণীয় সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।

দেশে করোনা প্রবেশের প্রথম দিকে করোনা পজিটিভ হলে অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরাই রোগীর খোঁজ খবর নিতেন বলে জানান ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।