logo
আপডেট : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:০৭
‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে’
পলাশ রায়, ঝালকাঠি

‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে’

ঝালকাঠি শহরের কোলঘেঁষে বয়ে চলেছে সুগন্ধা নদী। শান্ত এ নদী যেন চারদিক থেকে পুরো শহরটিকে ঘিরে রেখেছে। সভ্যতার ক্রমবর্ধমান ছোঁয়ায় আজকের ঝালকাঠি শহরে রয়েছে সুউচ্চ অট্টালিকা, স্কুল-কলেজ, হাসপাতালসহ নানা স্থাপনা। রয়েছে নাগরিক জীবনের সব সুযোগ সুবিধাও। তবে এখনকার শহুরে সভ্যতার আগে নদীবিধৌত উপকূলীয় এ জেলায় সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করে জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা। এ জেলায় তাদের অবস্থান ৩০০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে। কিন্তু দলিত এ সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য আজও গড়ে ওঠেনি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। যুগের পর যুগ জেলে পরিবারগুলোর বসবাস প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা প্রতিক‚লতার মাঝে।


এ যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের সেই কেতুপুর গ্রাম। এখানেও দারিদ্র্য আর দুঃখ শোকে কাটে অসংখ্য কুবের, মালা আর কপিলাদের নিত্যদিন। আছেন হোসেন মিয়ারাও। কারণ সুখ আর আনন্দে গাঁথা জেলেপাড়ায় সময়ের বিবর্তনে আজ চৈত্রের দাবদাহ। বর্ষার মৌসুম ছাড়া জেলেরা এখন নদীতে মাছ দেখে না বললেই চলে। এছাড়া চরম দারিদ্র্যের দিনে নৌকা ও জাল সংগ্রহের অভাবে বেকার হয়ে পড়েছে জেলেরা। তাই পেশা হারিয়ে দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে তারা। বর্তমানে সেখানে ৮ থেকে ১০টি জেলে সম্প্রদায় এখনো পূর্বপুরুষের পেশা আঁকড়ে ধরে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। তবে এনজিও, দাতা সংস্থাসহ সরকারি সংস্থাগুলো জেলেদের পাশে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বিপরীতে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন কথিত ভদ্র সমাজের লোকেরা। তাই তো মনের অজান্তেই জেলেরা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে, ‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্র পল্লিতে-এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’


অথচ একসময় সন্ধ্যার শাখা সুগন্ধা, বিশখালী, জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি নদীতে জেলেরা মাছ ধরতে নৌকায় সকাল সন্ধ্যা কাটিয়ে দিত। দিন শেষে নৌকা বোঝাই মাছ গঞ্জের হাটে বিক্রি করত। এরপর চাল ডাল কিনে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরত তারা। এ অঞ্চলের জেলেরা সনাতনধর্মী হওয়ায় বারোমাসে তাদের তের পার্বণ লেগেই থাকত। বিশেষ করে মনসা পূজা, বাস্ত পূজা, নীল পূজা, হোলি উৎসব আর গঙ্গা পূজার ঘটা লেগে থাকত নির্ধারিত দিনের সাত থেকে আট দিন আগে থেকেই। সেসময় জেলেপাড়ায় সকাল আর সন্ধ্যা হতো তুলসী তলায় জেলে নারীর শাঁখের ধ্বনিতে। আজও জেলে পাড়ায় শাঁখের শব্দ বাজে, তবে এ শব্দে কান্নার করুণ সুর ধ্বনিত হয়। মর্মস্পর্শী অনুভবে তা স্পষ্ট শোনা যায়।


জেলেদের জীবন : জেলেপাড়ার অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ নবদ্বীপ (৬৫)। তার বয়সের তুলনায় তিনি যেন আরো বৃদ্ধ। নদীতে মাছ ধরেই শৈশব থেকে বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। বছরের পর বছর নদীতে রোদ, বৃষ্টি, আর শীত তার শরীরের ওপর দিয়ে গেছে। তাই নানা রোগ শোকে এখন বিছানায়। তিনি জানান, একসময় ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠি আর গুরুধাম এলাকায় জেলেরাই শহর জমিয়ে রেখেছিল। তখন নদীতে মাছের অভাব ছিল না। এখন আর আগের মতো মাছ নেই। তাই অভাব দারিদ্র লেগেই আছে। সরকারি সাহায্য সহযোগিতা কিছুই পান না বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। আরেক জেলে বরুণ মালো বলেন, ‘এই শীতে হুনছি অনেকে গরিবগো কম্বল দেছে। মোগোতো কেউ একটাও দেলো না।’


স্থানীয় জেলে বিপুল মালো বলেন, ‘ এখন গাঙে মাছ নাই। আমরা সরকারি সাহায্যও পাই না। তাই পিকআপ ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাই। আর ইলিশের সময় গাঙে থাকি।’ ঝালকাঠি জেলা মৎস কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ জানান, জেলায় মোট জেলের সংখ্যা ৪ হাজার ৬৩০ জন। তবে শহরে এ সুগন্ধার জেলেরা প্রাচীন জনপদের ঝালো সম্প্রদায়ের বংশধর। নদীতে মাছ না থাকার প্রসঙ্গে তিনি জানান, জেলের সংখ্যা বেড়েছে। আর ঝালকাঠি একটি পকেট জেলা। ভোলা-পটুয়াখালী, বরগুনা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়ে। বাকি কিছু অংশ সুগন্ধায় আসে। তবুও ইলিশ সংরক্ষণে সরকার গত কয়েক বছর ধরে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে, তাতে নদীতে ইলিশ বেড়েছে। ঝালকাঠিতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যদিকে সাধ্যমতো জেলেদের সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি এ কর্মকর্তার।


ঝালকাঠি নাম কোথা থেকে এলো? : ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঝালকাঠি শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি গুরুধাম ও শশ্মানঘাট সুগন্ধা নদীসংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠে জেলেদের ওই বসতি, যা আজও ঝালোপাড়া নামে পরিচিত। মূলত কৈবর্ত জেলেদের ঝালো বলা হতো এবং তাদের বসতির এলাকাকে বলা হতো ঝালোপাড়া। অনেকের ধারণা এ ঝালোপাড়া থেকেই ঝালকাঠি নামের উৎপত্তি। কবি বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গল কাব্যেও জেলে সম্প্রদায়কে ঝালো নামে উল্লেখ করেছেন।


প্রাচীন বাণিজ্যিক বন্দর ঝালকাঠির পূর্বে অধিকাংশ নাগরিকই ছিল কৈবর্তদাস বা জেলে সম্প্রদায়ের লোক। অনেকের মতে, বর্তমান ঝালকাঠির পশ্চিম তীরে জেলেরা জঙ্গল সাফ করে বাসস্থান তৈরি করে। আর তা থেকে জেলে+কাঠি=জাল+কাঠি অপভ্রংশে ঝালকাঠি নামকরণ করা হয়েছে। এই জেলে ও জঙ্গলের কাঠি থেকেই উৎপত্তি হয় ঝালকাঠির নাম। এখানের তিন চারটি পরিবার থেকে আস্তে আস্তে ঝালকাঠি শহরের চাঁদকাঠির সুগন্ধা পাড়ে জেলেপাড়া গড়ে ওঠে। এখানকার জেলেরা ঝালো ও মালোÑ এ দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। বিশ্বরূপ সেনের একখানি তাম্রলিপিতে ঝালকাঠি ও নৈকাঠির নাম উল্লেখ রয়েছে। আর এ থেকেও ঝালকাঠি নামটি যে জেলেদের কাছ থেকে পাওয়া তার সমর্থন পাওয়া যায়। তবে ঝালকাঠি জেলার প্রাচীন নাম ছিল মহারাজগঞ্জ। কিন্তু ঝালকাঠি নামেই জেলার নামকরণ টিকে যায়।