logo
আপডেট : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৪১
ধনী ও বড়লোক সমার্থক নয়

ধনী ও বড়লোক সমার্থক নয়

ধনীরা সব সময় মনে করে তার ধনসম্পদ কম। এজন্য আরো উপার্জন করা দরকার। বিত্তশালীরা মনে করে, তাদের বিত্ত বৈভব এখনো যথেষ্ট পরিমাণ নয়। একজন বিত্তশালী আরো মনে করে, সে এখনো বড়লোক হয়নি। তার বড়লোক হওয়া দরকার। বড়লোকদের মানসম্মান ও সমাজে জনপ্রিয়তা আছে কিন্তু তার নেই। তাই তাকে বড়লোক হতে গেলে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হবে অতি দ্রুত। আর জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হলে তার চাই পদবি। পদবি তো আর এমনিতেই অর্জন করা যায় না এজন্য দরকার বিশেষ ক্ষমতা। তাই একজন নব্য ধনবান ব্যক্তি বিত্তশালীর কাতারে উঠার পর সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।


তৃতীয় বিশের দুর্বল গণতান্ত্রিক বা দুষ্ট গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সম্পন্ন দেশগুলোতে যেনতেনভাবে অর্জিত আর্থিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মাঝে বড়লোক হওয়ার সাধ প্রবল। আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে দারিদ্র্য পীড়িত ও সুশাসন বঞ্চিত এলাকাগুলোতে হঠাৎ ধনী হওয়া কিছু মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জনের মাধ্যমে বড়লোক হওয়ার এই প্রবণতা আরো বেশি প্রবল।


আগে বলা হতো, ‘ধানে ধনী, পাটে মান, পাট চাষে এগিয়ে যান’। এখন তুলার যুগ শুরু হওয়ায় এবং তুলার কাপড় বেশি সস্তা ও জনপ্রিয় হওয়ায় পাটের দাম ও চাহিদা কমে গছে। ফলে পাটের আবাদ ও কদর কমে গেছে। ধানের আবাদ বেড়েছে পেটের ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে। ক্ষুধা মেটানোর জন্য বিকল্প খাদ্য ব্যবস্থাও রয়েছে। এজন্য ধান-চাল আমদানি করা হয়ে থাকে। অনেক সময় ধানের আবাদ বেশি হলে ধানের দামও কমে যায়।
অতীতের মতো ধান উৎপাদনকারী উর্বর জেলা বা অঞ্চলকে আর বেশি ধনী এলাকা বলা হয় না। আগেকার দিনের ‘গ্রেনারি অব ফুড’ নামক জেলাগুলোকে এখন সেই মর্যাদা ও পাত্তা দেয়া হয় না। এমনকি সাতক্ষীরার লোনা অঞ্চলে ও বান্দরবানের পাহাড়ের মধ্যে এখন উন্নতজাতের মিষ্টি আম উৎপাদিত হওয়ায় চাঁপাই বা দিনাজপুরের বিখ্যাত আম-লিচুর কথা ততটা মনে দাগ কাটে না। এখন সব জেলাতেই সব ফসলের বাম্পার উৎপাদন হয়ে থাকে। আজকাল ফল-ফসলের স্বাদ কমবেশি হলেও যারা সবার আগে বাজার ধরতে পারে তারাই আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে যাচ্ছেন।


আগেকার দিনে যার বাড়িতে বছরজুড়ে ধান থাকত তাকে ধনী বলা হতো। যেসব গ্রামে অধিক ধান উৎপাদনকারী উর্বর জমি এবং বেশি ধান ফলিয়ে সেটা অভাবের সময় বিক্রি করে বেশি টাকা উপার্জন করতে পারত সেসব গ্রামকে বলা হতো ‘ধনীটারি’। যেসব গ্রামের মাটি উষর, অনূর্বর বালুময় এবং ভালো ফসল বা ধান ফলত না সেগুলোকে বলা হতো ‘বালাটারি’।


আগে মানুষের বেশি পরিমাণ ধান থাকলে ধনী বলা হতো। এখন কিছু ধন-সম্পদ থাকলে ধনী বলা হয়। এখনকার দিনে ধনীরা নানা উপায়ে ধন-সম্পদ উপার্জন করে। এজন্য এখন উর্বর জমির মালিক হওয়ার প্রয়োজন হয় না। অনেক দেশে ভূমিহীন অনেক মানুষ আজকাল বিলিওনিয়র। আমাদের দেশেও অনেক জমিহীন মানুষ কোটিপতি। অবাক করার মতো বিষয়টি হলো- অনেক চাকরিবিহীন, ব্যবসাবিহীন, সৎকর্মবিহীন অলস মানুষও আমাদের দেশে হঠাৎ কোটিপতি হয়ে যায়। তারা কোনো গুপ্তধন বা আলাদিনের চেরাগও হাতে পান না, তবুও দ্রুত কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। বিদেশের একজন নব্য বিত্তশালী ও আমাদের দেশের একজন নব্য বিত্তশালীদের মধ্যে এখানে বিস্তর ফারাক লক্ষ্যণীয়।


বিষয়টা বৈধ-অবৈধ কাজের মধ্যে নিহিত বিধায় আমাদের দেশের একজন নব্য বিত্তশালীর মধ্যে নানা নেতিবাচক ঘটনার জন্ম নিতে দেখা যায়। তারা টাকা আয় করে, গোপনে জমায়। বালিশের মধ্যে, বিছানার তোশকের মধ্যে টাকার বিছানা তৈরি করে শুয়ে থাকার ঘটনাও আছে। তারা অবৈধ অর্থ জমায় অতি গোপনে এবং পাচার করে চক্রের মাধ্যমে সন্তর্পণে।


বিদেশে পাচার করে দেশে ধরা পরার ভয়ে, কর ফাঁকি দেওয়ার আতঙ্কে। শুধু ফি-বছর অন্যায়ভাবে উপার্জিত কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা পাওয়ার আশায় কিছু টাকা নামে-বেনামে দেশে লুকিয়ে রাখে। প্রতিবছর এই অন্যায় সুযোগ দেয়া হয় কারণ, এ কাজে দাবিদারে সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক রাঘববোয়ালরা এদের সাথে জড়িত থাকে। অর্থনীতির ভাষায় এর পক্ষে যে যেই যুক্তি দিন না কেন এটা অনৈতিক ও দুর্নীতি করার একটি বড় সহায়ক উপায় ছাড়া আর কিছুই নয়। পাশাপাশি মানুষের সৎ থাকার মননশীলতাকে আঘাত দেয়ার অন্যতম ঘৃণ্য পন্থা মাত্র।


এসব উঠতি ধনীরা খুব কৃপণ প্রকৃতির। তারা ফকির, ভিক্ষুক, গরিব-দুর্বলদের ঘৃণা করে। অহমিকা, অহঙ্কার গৌরব ও চলাফেরায় চাকচিক্য বেশি ওদের। প্রতিটি কাজকে তারা অবহেলা করে, শুধু তাদের গোপন অর্থ-আয়ের কারবারটি ছাড়া। বখিলতার কারণে এসব নব্য ধনীদেরকে মানুষ পছন্দ করে না, ঘৃণা করে। তাই তারা প্রতিবেশীসহ সাধারণ মানুষকে এড়িয়ে চলে। এজন্য তারা ব্যবহার করে নিজস্ব পোষা বডিগার্ড ও পেশিবহুল নির্যাতনকারী একদল মানুষকে। যারা তাদের পোষা শিষ্য নামে অভিহিত এবং তারা তাদের সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারা পায়।
এসব উঠতি ধনী ও আসল বড়লোকের সংজ্ঞা এক নয়। টাকা ছাড়াই মানুষ মানুষকে সম্মান করে, ‘বড়লোক’ বলে তারা সেটা বুঝতে পারে। আর অনেক টাকা থাকলেও তাদেরকে ‘ছোটলোক’ বলে তারা সেটাও অন্তর দিয়ে অনুভব করে। ফলে সেখানেই তৈরি হয় দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। এটাই ন্যায়-অন্যায়ের পরস্পরবিরোধী ও সংঘাত তৈরির উপাদান। এটা বিত্তশালী ও বড়লোকের মধ্যেকার আসল পার্থক্য। বড়লোকেরা মানী ও গুণী ব্যক্তি। তারা অনেকেই সম্পদহীন, ধনী নন। তারা অহেতুক বেশি অর্থ জমা রাখেন না। তারা জ্ঞানী, পরোপকারী। মিথ্যে বলেন না, চোগলখুরি করেন না। জালিয়াতি, ঘুষ-দুর্নীতি করেন না। তারা শুধু বাহ্যিক ভোগ-বিলাস নিয়ে চিন্তা করেন না।


আজকালকার নব্য ধনীদের নতুন নতুন পাখা গজায়। তারা সবসময় সুবিধাবাদী হিসেবে দল বদল করে। তাদের পেশি সবসময় ফুলেই থাকে দুর্বলদের ওপর আঘাত হানার জন্যে। তবে তাদের চেয়ে সবলদেরকে দেখলে তারা নতজানু হয়ে সেলাম করতে কুণ্ঠিত নয়। এসব নব্য পোষা ও পেশিধারীদের ক্ষমতা লাভ করে বড়লোক হওয়ার সাধ ও স্বাদ জাগলেই সমাজে সমস্যা তৈরি হয়। এতেই ঘটে বিপত্তি, এতেই শুরু হয় হানাহানি ও সংঘাত। এ থেকেই শুরু হয় ঘৃণ্য রাজনীতি। যে কোনো নির্বাচন এলেই এরা আরো বেশি তৎপর ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কালো টাকা ছড়িয়ে দেয় নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে। এরা ভাবে ও বলেও বেড়ায়Ñ ‘টাকাই করে কাম, শুধু বাপের নাম’। এরা দুর্নীতি, বেঈমানি, চুরি-ডাকাতি করতে দ্বিধা করে না। অন্যায় কাজ করতে গিয়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রতিপক্ষকে গুলি-খুন করা তো তাদের কাছে নস্যি।


গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে কাঁচা মাটির রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকে। পেশিতন্ত্র পাকা রাস্তা দিয়ে হাল-ফ্যাশনের গাড়িতে জানালা বন্ধ করে চলাফেরা করে। সে গাড়ির সিটের নিচে থাকে মাদক-ইয়াবা, ক্রিস্টাল, আইস আরো কতকিছু! বিদেশ ভ্রমণের আগে-পরে তাদের উড়োজাহাজের সিটের নিচে ঢুকে যায় মাদক, স্বর্ণ, হীরা-মণিমুক্তারা। এজন্য তাদের পোষা সেবাদাসরা সব ঘাটে ঘাটে তাদের রক্ষা করতে ও পক্ষে সাফাই গাইতে তৎপর থাকে।


করোনাকালে এসব মানুষের তৎপরতা ও ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তি অনেক বেড়ে গেছে। আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যাপক প্রচলনে এরা বেশি খুশি। কারণ, ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিজে আড়ালে থেকে টেকনিশিয়ানকে নিয়োগ দিয়ে অবৈধ সুযোগের ব্যবহার করার সুবিধা বেশি। এত দোষ নিম্নপদস্থদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করা যায়। এভাবে আমাদের অনলাইন প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর মাধ্যমে সেবাদান কার্যক্রমকে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ের সেবাগ্রহীতারা যারা এসব জ্ঞান রাখেন না তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে ডিজিটাল দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে।


তারা ধনী সমাজের ধজ¦াধারী আমাদের আধুনিক কৃষ্টির পৃষ্ঠপোষক। তারা নিজেদের নাম পাল্টিয়ে ভোল বদলাতে চায়। কিন্তু তা করতে পারে না। কারণ, কয়লা শতবার ধুলেও ময়লা যায় না, কালোই থাকে। কয়লার ময়লা উঠানো যায় না। তবুও তারা লোক দেখানো ভালো কাজে ব্যস্ততা প্রকাশ করে। কারণটা, এখনো তারা বড়লোক হয়নি বা হতে পারেনি। তবে এসব অবৈধ ধনীরা অবৈধভাবে ক্ষমতা লাভ করলেও কখনো সমাজের আস্থাবান বা মানী লোক হয় না। বড়লোক তো নয়ই! যদি কোনোভাবে অবৈধ পন্থায় অর্জিত বিত্তশালীরা ক্ষমতা লাভ করে তাদের ইস্পিত দুষ্ট ‘বড়লোকতন্ত্র’ কায়েম করতে সমর্থ হতে থাকে তাহলে মানুষের চিরায়ত শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে এবং সামাজিক ভাঙন ত্বরান্বিত হয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে গিয়ে ন্যায়াগুগ সমাজব্যবস্থা উধাও হয়ে যেতে দেরি হবে না।

লেখক: রাজশাহী বিশ্বিবিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।