শিল্পায়নের কারণে দিন দিন যান্ত্রিকতার যুগে প্রবেশ করছি আমরা, আর বায়ু দূষণের মাত্রাও বেড়েই চলেছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের জীবন-যাত্রার মান যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি শিল্পায়ন ও অপরিনামদর্শী কর্মকান্ডের দরুন পৃথিবীর নির্মল পরিবেশে বিষাক্ত পদার্থের অনুপ্রবেশ ঘটে পৃথিবীর পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতি সাধন করছে।
বৈশ্বিক বায়ু মান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি ২০২২ সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত বিশ্বের ১০০টি বড় শহরের মধ্যে বায়ু দূষণের দিক থেকে ঢাকা ছিল শীর্ষে এবং মাত্রা ছিল ২৮৯। সাধারণত বায়ুমানের সূচক ২০০ অতিক্রম করলে একে খুব অস্বাস্থ্যকর বলে ধরা হয়। পরিবেশ অধিদফতরের নির্মল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীর বায়ু ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন বিপজ্জনক ছিল। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিনে। পর্যায়ক্রমে ২০১৬ সালে ১৯২ দিন, ২০১৭ সালে ২১২ দিন, ২০১৮ সালে ২৩৬ দিন, ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন ঢাকার বায়ু দূষিত ছিল, যার ধারাবাহিকতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে বায়ুদূষণের তালিকায় প্রথম হয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা।
আমাদের দেশের শহরগুলোতে বায়ু দূষণের জন্য মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি শীতকালীন মৌসুমে। বর্ষাকালে বায়ূ দুষণ থাকে কম । শীতকালে বেশি বায়ু দুষণের মূল কারণ ক্ষুদ্র বস্তুকণা। সাধারণত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলায় এগুলো সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে কয়লা পোড়ানো হয় এমন শিল্পকারখানার সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশে যে নির্মাণকাজ হচ্ছে, তাতে প্রচুর ধুলা ও ধোঁয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ওই ক্ষুদ্র কণাগুলো এমনিতেই বেশি পরিমাণে পরিবাহিত হয়। আর এই সময়ে বেশি নির্মাণকাজ চলে এবং সব কটি ইটভাটা চালু থাকায় দুষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে যে নির্মাণকাজগুলো হচ্ছে, এখানে নির্মাণসামগ্রী বিশেষ করে বালু ও ইট পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু রাজধানীর বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রেখে ধুলা সৃষ্টি করছে। নিয়ম মানার চেষ্টা খুব কম লোকই করে থাকেন। রাস্তা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ, পানি ছিটানো, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি ছিটানো এবং নির্মাণ সামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃতকরণ বিষয়গুলো সীমিত আকারে আছে কিন্তু এটিকে আরো জোরদার করার জন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য এবং নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দারা বায়ুদুষণের প্রধান শিকার। বিশ্বের সবচেয়ে বায়ুদুষণের কবলে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শহরের অবস্থান উপরের দিকে। এই শহরের বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তু কণিকার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম ২.৫) পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। ক্ষুদ্র বস্তু কণিকার আকার ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার। অত্যন্ত ক্ষুদ্র হওয়ায় এসব কণিকা খুব সহজেই মানুষের শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে পুরো শরীরে ছড়িয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ 'এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স' এ বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে সারা দেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর ছয় মাস। লাইফ ইনডেক্সের গবেষণা মতে, ১৯৯৮ সালে বায়ু দূষণের কারণে গড় আয়ু কমেছিল প্রায় দুই বছর আট মাস, ২০১৯ সালে সেটি পাঁচ বছর চার মাসে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা বলছে, সারা দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী অন্তত তিনগুণ বেশি।
বায়ুদূষণ রোধে সুদূরপ্রসারি ও সমন্বিত পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। যেসব কারণে বায়ুর দূষণ হচ্ছে সেসব যথাযথভাবে চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ আরো বাড়াতে হবে। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০ শতাংশ দুষণ কমানো সম্ভব। এ পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর দেশে বিদ্যমান সনাতন পদ্ধতির ১২০ ফুট চিমনিবিশিষ্ট ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরের জন্য কাজ করে যাচ্ছে এবং সনাতন পদ্ধতির নতুন ইটভাটার অনুকূলে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান বন্ধ করা হয়েছে।
সাধারণত সচেতন জনগণ খাবার পানির জন্য অর্থ ব্যয় করে থাকেন কিন্তু পরিশুদ্ধ বাতাসের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে ঠান্ডা বাতাস পেয়ে থাকেন, কিন্তু পরিশুদ্ধ ঠান্ডা বাতাসের পরিবর্তে অধিকতর দূষিত ঠান্ডা বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। ফলে বায়ুবাহিত রোগ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। বিষয়টি বিবেচনাপূর্বক প্রত্যেককেই মনোযোগী হতে হবে। কার্যকর ও সমন্বিত উদ্যোগ এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
হাসপাতালগুলোতে ইনফেকশনের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে দূষিত বা সংক্রমিত বায়ু। বাংলাদেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর রোগীদের বায়ুদূষণের মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই বিষয়টি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে বায়ুদূষণজনিত রোগ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এ কথা ঠিক যে, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। তবে মেট্রোরেল চালু হলে এই দূষণের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি শিগগিরই ঢাকা শহর থেকে তুলে দিতে পারলে বায়ুদূষণ অনেকটাই কমে যাবে। যানবাহন সৃষ্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে গাড়ির ধোঁয়া পরিবীক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ এবং বিধিবদ্ধ মানমাত্রার অধিক দূষণ সৃষ্টিকারী গাড়ির বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
উন্নত বিশ্ব বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখতে কী কী পদ্ধতি ব্যবহার করছে, সেসব নতুন প্রযুক্তির দিকে আমাদের আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। একইসঙ্গে জনগণকে বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে কিংবা সচেতন হতে সহায়তা করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে, একটি সুন্দর পৃথিবী প্রস্তুত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। বায়ুকে নির্মল করে তুলতে হলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ আমার জীবনের জন্য, বাঁচার জন্য অত্যাবশ্যক। নির্মল বায়ু, বিশুদ্ধ ও সতেজ বায়ু ছাড়া সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও সমাজসেবা সম্পাদক,
গ্রিন এনভায়রনমেন্ট মুভমেন্ট।