logo
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০৮:৩৩
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির চেষ্টায় রাশিয়া ও চীন

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির চেষ্টায় রাশিয়া ও চীন

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের শি জিনপিং গত সপ্তাহে এক নতুন বৈশ্বিক ব্যবস্থার ঘোষণা করেছেন। তাদের এই ঘোষণায় অন্তত স্বল্পমেয়াদি হলেও নিজ নিজ আঞ্চলিক উচ্চাকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। যেমন, রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং চীনের তাইওয়ান দখলের প্রচেষ্টায় সাহস জোগায়।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই স্বৈরশাসকের মধ্যে সম্পাদিত এই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির লক্ষ্য হলো বিশ্বশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করা, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংগঠন ন্যাটো ও উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানো।

বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক শুরুর প্রাক্কালে এই দুই নেতার সাক্ষাতের পরে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয় ‘চীন ও রাশিয়ার মধ্যে  বন্ধুত্বের সম্পর্ক অসীম এবং এই সহযোগিতার সম্পর্ক সর্বক্ষেত্রে বিদ্যমান।’

মস্কো এবং বেইজিংয়ের মধ্যে ২০০১ সালের বন্ধুত্বের চুক্তি ছিল এবং ঐতিহ্যগতভাবে এই চুক্তিটি উচ্চাভিলাষী। এই চুক্তিটি অস্পষ্ট বিদায় তা ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে। চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত নতুন এই চুক্তির কথা উল্লেখ করে ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কিসিঞ্জার ইনস্টিটিউটের পরিচালক রবার্ট ডালি বলেন, এই চুক্তিটি কেবলই পাঁচ হাজার শব্দের একটি সাধারণ কল্পনাপ্রসূত দলিল নয়।

এই চুক্তিটি যদিও ন্যাটোর মতো আনুষ্ঠানিক কোনো সামরিক জোট নয় তবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত এবং সংহতিমূলক। ড্যালির মতে ‘এই চুক্তিতে আমেরিকা এবং পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আদর্শিক এবং সামরিকভাবে প্রতিহত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই বিবৃতিটিকে দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ শুরু প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।’ ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তে উত্তেজনা, তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের আগ্রাসন এবং এই বিবৃতিÑ ‘ইতিহাসবিদদের মনে শীতল যুদ্ধের সময়কে মনে করিয়ে দেয়’ বলে মনে করছেন ড্যালি।

জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুর বাইরেও দুই নেতার ঘোষণায় মহাকাশ, জলবায়ু পরিবর্তন, ইন্টারনেট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো বিষয়ে সহযোগিতার অঙ্গীকার করা হয়েছে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করে যৌথ বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ‘বিশেষ ধরনের গণতন্ত্র সবার জন্য’ প্রযোজ্য নয় এবং মস্কো এবং বেইজিং মনে করে কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্টায় তারা সফল হয়েছে।

রাশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভার্সবো বলেন, ‘এই দুই দেশ একটি জোট গঠনের কাছাকাছি অবস্থায় আছে এবং তারা একবিংশ শতাব্দীতে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করতে চায়।’ পুতিন চীনের সঙ্গে বৃহত্তর কৌশলগত অংশীদারত্বকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে বর্ণনা করেছেন। অন্যদিকে শি বলেন, ‘তাদের এই যৌথ কৌশলপত্র চীন, রাশিয়া এবং বিশ্বের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা এই দীর্ঘ বিবৃতিকে মিথ্যা অভিযোগে ভরপুর আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমি কখনই এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা যৌথ বিবৃতি দেখিনি। তারা একটি শক্তিশালী জোট গঠন করছে ’ বলছেন ন্যাশনাল ইন্টিলিজেন্সে কাউন্সিলে কাজ করা অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট। অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট একজন রাশিয়ান যিনি ‘পুতিন’স ওয়ার্ল্ড : রাশিয়া এগেইনস্ট ওয়েস্ট অ্যান্ড দ্য রেস্ট’ এই নামে একটি বইও লিখেছেন।

অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট এই বিবৃতিটিকে ‘অরওয়েলিয়ান এবং ঘটনাবহুল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই বিবৃতিটিতে রাশিয়া এবং চীন চলমান বিশশক্তির ভারসাম্যকে চ্যালেঞ্জ করছেন। অ্যাঞ্জেলা স্টেন্ট বলন ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয় আমরা একটি নতুন বিশ^ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে যাচ্ছি’।

ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার শক্তি প্রদর্শনের সময়ে এই যৌথ বিবৃতিটি পুতিনের জন্য এই মুহূর্তে কূটনৈতিক আশীর্বাদ। রাশিয়ার সাম্প্রতিক কোনো আগ্রাসনে প্রথমবারের মতো পুতিন চীনের নেতার প্রকাশ্য সমর্থন পেয়েছেন। চীন ২০০৮ সালে জর্জিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ, ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসন কিংবা ক্রিমিয়া দখলকে চীন স্বীকৃতি দেয়নি।

জাতিসংঘে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী মস্কো এবং বেইজিং ন্যাটোর নতুন করে সম্প্রসারণের যেকোনো প্রস্তাবে এবং অন্যান্য আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট গঠনের প্রস্তাব ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে খারিজ করে দেয়।

ডালি বলেছিলেন ‘রাশিয়া এবং চীন নিজ নিজ অঞ্চলে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্টের বহিরাগত শক্তির চেষ্টার বিরুদ্ধে একজোট। দেশ দুটি যেকোনো মূল্যে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করবে এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াবে।’

বেইজিংকে ইউক্রেন ইস্যুতে দূরে রাখতে ওয়াশিংটন চাপ দিয়ে আসছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত টেলিফোন আলাপে চীনকে ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ থাকতে বলা হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘পুতিনের ইউক্রেন নিয়ে জঘন্য এবং ইত্তেজনাপূর্ণ অবস্থান সমর্থন করার জন্য এখন রাশিয়ার পাশে চীন রয়েছে’ বলে মনে করেন অ্যান্ড্রু ওয়েইস।

ইউক্রেন নিয়ে চীনের অবস্থান পরিবর্তনের ইঙ্গিত গত দুই সপ্তাহ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ ইউক্রেন সংকটের কারণে সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের চীন নীতিতে বেইজিংয়ের সঙ্গে স্থিতিশীল এবং ভারসাম্যপূর্র্ণ অবস্থার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়াকে চীনের সমর্থনের প্রতিক্রিয়ায় স্টেট ডিপার্টমেন্ট সতর্ক করে দিয়ে বলছে যে, চীন ও বিদেশি কোম্পানি যারা রাশিয়াকে শাস্তি এড়াতে সাহায্য করছে তাদের বিরুদ্ধে মোতায়েন করার মতো পশ্চিমাদের হাতে যথেষ্ট ব্যবস্থাপত্র আছে।

চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পাদিত নতুন চুক্তিতে, রাশিয়া বেইজিংয়ের এক চীন নীতির প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এই চুক্তিতে আরো বলা হয়, তাইওয়ান ‘চীনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দেশটির যেকোনো স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করা হয়। দুই নেতার যৌথ বিবৃতিতে গত দুই বছরে হংকংয়ের ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর বেইজিংয়ের নির্মম ধরপাকড়কে ও সমর্থন করা হয়। যৌথ বিবৃতিতে গত এক দশকে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক গভীর হওয়াকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বলে মনে করেন ওয়েইস।

রাশিয়া এবং চীন প্রায় হাজার দশেক সৈন্য নিয়ে কয়েক ডজন যৌথ মহড়া এবং যুদ্ধ অবস্থার সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছে। রাশিয়ান কর্মকর্তারা গর্ব করে বলছেন যে, চীন ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটোকে চাপে রাখার জন্য যাতে পশ্চিমারা মস্কোর ওপর চাপ প্রয়োগ না করতে পারে।

এই নৌ মহড়ার মধ্যে রয়েছে কাল্পনিক দ্বীপ দখল, জাপান সাগর এবং পূর্ব চীন সাগরের ওপর দূরপাল্লার বোমারু বিমানের টহল এবং ভূপৃষ্ঠ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়ন। গত গ্রীষ্মে, পুতিন এবং শি উভয়েই চীনে অনুষ্ঠিত সামরিক মহড়ায় উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে গত বছরের অক্টোবরে, তারা রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে যৌথ নৌ মহড়ায় অংশ নিয়েছেন।

বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুতিন ছিলেন সবচেয়ে হাই প্রোফাইল নেতা। যুক্তরাষ্ট্র ও প্রথম সারির দেশগুলো চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদের অংশ হিসেবে (বিশেষ করে উইঘুর সংখ্যালঘুদের ওপর) প্রথম সারির সরকারি প্রতিনিধিদল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়া অলিম্পিকে ডোপিংয়ের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কারার অপরাধে অলিম্পিক থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছেন আগেই।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ভার্সবো বলেন এখন দেখার বিষয় হচ্ছে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তি দেশ দুটি কতদূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। ‘দেখতে হবে চুক্তির এই কথাগুলো কি বলার জন্যই বলা’ বলেন, ভার্সবো। ‘আমাদের এখনো দেখতে হবে যে বিবৃতিটি কি রাশিয়ার আক্রমণাত্মক আচরণের প্রতি চীনের এই সমর্থন নাকি অন্য কিছু যেমন, ‘আমরা আপনার সঙ্গে আছি, শুভ কামনা রইল’  এবং তারপর মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।’

যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন অনেক বেশি বাস্তববাদী। কারণ দেশটির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভার্সবো মনে করেন ‘রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে চীন তার সব অর্থনৈতিক সম্পর্ক জলাঞ্জলি করতে চাইবে না নিশ্চয়’।

দ্য নিউ ইয়র্ককার থেকে অনূদিত।