logo
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:২৮
ছবি ও ভিডিওতে ব্ল্যাকমেইল, মুহূর্তেই উধাও অর্থ
রুদ্র মিজান

ছবি ও ভিডিওতে ব্ল্যাকমেইল, মুহূর্তেই উধাও অর্থ

ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ভিডিও কলে চরম উষ্ণতা ছড়াচ্ছেন এক নারী। নিজের মুখ ছাড়া পুরো শরীর প্রদর্শন করছেন তিনি। তার প্রতিটি কথায়, ভেজা ভেজা কণ্ঠে চরম উত্তেজনা। ওই নারী তার সঙ্গে তাল মেলাতে বলেন অপর প্রান্তে থাকা ব্যবসায়ী পুরুষকে। পুরো উলঙ্গ দেখতে চান তাকে। ব্যস, পুরুষটি মুহূর্তেই ওই নারীর চাওয়া পূর্ণ করেন। এভাবে প্রায় ছয় মিনিট। উত্তেজনা এখানে শেষ হলেও ঘটনার শুরু সেখান থেকেইে। পরদিনই চমকে ওঠেন ওই ব্যক্তি। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তার। তাকে একটি খুদেবার্তা পাঠিয়েছেন ওই নারী। ভয়ংকর সেই বার্তা। ‘১ ঘণ্টার মধ্যে ২৫ হাজার টাকা না পাঠালে আপনার পরিবার, আত্মীয়-স্বজনসহ সবাইকে এই ভিডিও পাঠিয়ে দেব।’ ভিডিও কলে কথা বলার সময় স্ক্রিন রেকর্ডার ব্যবহার করে ৬ মিনিটের ভিডিওটি ধারণ করেছেন ওই নারী। আতঙ্কিত হয়ে ওই নারীর কথা অনুযায়ী ২৫ হাজার টাকা পাঠান তিনি। এখানেই শেষ নয়। এভাবে প্রায়ই টাকা পাঠাতে হয় ওই ব্যক্তিকে। এ রকম অনেক অভিযোগ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের কাছে। এ রকম ডিজিটাল প্রতারণার শেষ নেই। ব্যাংক, বিকাশ থেকে অর্থ লুট, ছবি-ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল, লটারির পুরস্কার ও উপহার দেওয়ার নামে প্রতারণাসহ নানা অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে এই মাধ্যমে।


সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অভিযোগ এলেও শেষ পর্যন্ত মামলায় যাচ্ছেন না বেশির ভাগ ভুক্তভোগী। মামলা হচ্ছে ৩০ ভাগেরও কম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতারণার শিকার ওই ব্যক্তি জানান, প্রথমে একটি ফেসবুক আইডি থেকে রিকোয়েস্ট আসে। সুন্দরী নারীর ছবি। প্রোফাইল দেখে অন্তত তা মনে হচ্ছে। প্রতারক চক্র ভার্চুয়াল মাধ্যমে দ্রুত সম্পর্কের উন্নয় ঘটায়। এগিয়ে যায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনের মতো করে নাম, পরিচয় এমনকি ছবিও ব্যবহার করেন অনেকে। প্রতারকরা এই কাজে সিদ্ধহস্ত। প্রায়ই এ রকম প্রতারক গ্রেপ্তার হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে। রংপুর থেকে ফিরোজ আলম (২৭) নামে এ রকম একজনকে গ্রেপ্তার করেছে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন। ফারাবি ইসলাম শাওন নামে ফেইক আইডি ব্যবহার করত ফিরোজ। আপলোড করত বিমান ও বিভিন্ন বিমানবন্দরের ছবি। নিজেকে পাইলট হিসেবে পরিচয় দিত সে। নিজেকে পাইলট পরিচয় দিয়ে এক বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ উপস্থাপিকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়েছিল। সময়ে-অসময়ে কথা হতো ম্যাসেঞ্জারে, ফোনে। তারপর হঠাৎ অসুস্থতার খবর জানায় প্রেমিকাকে। এভাবে নানা অজুহাতে ওই সংবাদ পাঠিকার কাছ থেকে প্রায় ১৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় ফিরোজ। পাইলট পরিচয়ে এই সংবাদ পাঠিকাসহ অনেক মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ব্ল্যাকমেইল করত ফিরোজ। হাতিয়ে নিত বিপুল টাকা। রসায়নবিদ্যায় গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করলেও সাইবার প্রতারণায় তার দক্ষতা রয়েছে। এ ঘটনায় রাজধানীর আদাবর থানায় মামলা দায়েরের পর ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন।


এছাড়া আইডি হ্যাক করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কোনো ক্ষেত্রে ব্ল্যাকমেইল করে, কোনো ক্ষেত্রে আইডি হ্যাক করে ওই আইডিতে সংযুক্ত বন্ধুদের কাছে হঠাৎ সমস্যার কথা জানিয়ে টাকা ঋণ চেয়ে খুদেবার্তা পাঠানো হয়। টাকা দ্রুত আদায় করার চেষ্টা করা হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যাতে টাকা নেওয়া সম্ভব হয়। টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় সহজেই এক্ষেত্রে সফল হয় প্রতারকরা। এ রকম প্রতারণার শিকার ব্যক্তিদের অনেকে জানান, ঝামেলা এড়াতে তারা পুলিশমুখো হননি।


ব্যাংক থেকে উধাও হচ্ছে অর্থ। এ রকম ঘটনাও ঘটছে। গত ২৭ জানুয়ারি ব্যাংক কর্মকর্তাসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ব্যাংকের সার্ভার থেকে তথ্য নিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল এই চক্র। তাদের টার্গেট ছিল দেশের বড় বড় গ্রæপ অব কোম্পানি। ওয়ালট ও ইউনাইটেড গ্রæপের অ্যাকাউন্ট থেকে ১৮ কোটি ট্রান্সফারের চেষ্টা করছিল তারা। সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যাংক কর্মকর্তাকে প্রলোভন দিয়ে দলে টেনে তথ্য সংগ্রহ করে ডিজিটাল প্রতারণা করার চেষ্টা করছিল চক্রটি। কিন্তু ট্রান্সফারের আগে ফোনে যাচাই করতে গেলে বিষয়টি ধরা পড়ে। ২০১৬ আন্তর্জাতিক হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে। আলোচিত এই চুরির ঘটনার শুরু ২০১৫ সালে জানুয়ারিতে। রাসেল আহলাম নামে একজন চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তার কাছে একটি ই-মেইল পাঠান। ওই ই-মেইলের শেষে প্রার্থীর সিভি এবং কভার লেটারের ডাউনলোড লিংক দেওয়া ছিল। তাতে ক্লিক করার সঙ্গে সঙ্গে পুরো নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়ে ভাইরাস। আর নেটওয়ার্ক চলে যায় হ্যাকারদের কব্জায়। তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো কমপিউটার নেটওয়ার্ক ঘুরে দেখে। বিশ্লেষণ করে, ছক তৈরি করে।


এছাড়াও ঘটছে বিকাশ প্রতারণা। ‘আমি বিকাশ থেকে বলছি, আপনার অ্যাকাউন্টে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছু সমস্যা রয়েছে। আপনি যদি সমস্যাগুলো ঠিক না করেন অ্যাকাউন্টটি বন্ধ হয়ে যাবে। জমানো টাকা আর তুলতে পারবেন না। যদি ঠিক করতে চান তাহলে আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’ এভাবেই শুরু। তারপর কিছু প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য, ফোনে প্রেরিত খুদেবার্তার কোড নম্বর নিয়ে হ্যাক করা হয় বিকাশ অ্যাকাউন্ট। সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া ভোরের আকাশকে বলেন, বেশির ভাগ সাইবার অপরাধের মধ্যে রয়েছে সাইবার বোলিং, ব্ল্যাকমেইল। ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। এছাড়া বিকাশে প্রতারণা উল্লেখ্যযোগ্য। এসব বিষয়ে অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।