logo
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৭:১৬
বিএসএমএমইউর জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফল
আক্রান্তদের ৮২ শতাংশের শরীরে ওমিক্রন
নিজস্ব প্রতিবেদক

আক্রান্তদের ৮২ শতাংশের শরীরে ওমিক্রন

প্রতীকী ছবি

দেশে করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগী এবং বর্হিবিভাগের রোগীর মধ্যে ৮২ শতাংশ ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। বাকি ১৮ শতাংশ আক্রান্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে। এ তথ্য চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি- এই এক মাসের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণায় এ ফল পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের ২৯ জুন থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা করে আসছে বিএসএমএমইউ। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনার ২০ শতাংশ ছিল ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট।

তখন গবেষক দল ওমিক্রনের মাত্র একটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.1 পেয়েছিলেন। কিন্তু গত এক মাসে দেশে তারা ওমিক্রনের তিনটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট BA.1, BA.1.1, BA.2 পেয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী BA.2 বেশি সংক্রামক।

বিএসএমএমইউ-এর জিনোম সিকোয়েন্সিং রিসার্চ প্রজেক্টের প্রধান পৃষ্ঠপোষক (সুপার ভাইজার) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার দুপুরে কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার ফল প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এখন বাংলাদেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রধান উৎস, যেটি কিছুদিন আগে ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

বিএসএমএমইউ এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংগৃহীত নমুনা গবেষণার ফল প্রকাশ করে ১৮ জানুয়ারি। তখন সংগৃহীত নমুনার ৮০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়ার কথা জানান উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ। সেসময় তিনি পরের মাসে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট গুণিতক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

বৃহস্পতিবার বিএসএমএমইউর শহীদ ডা. মিল্টন হলে গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে উচাপার্য বলেন, ‘ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি সংক্রামক। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট জিনোমের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি মিউটেশন পাওয়া গেছে, যার বেশিরভাগ ভাইরাসটির স্পাইক প্রোটিনে হয়েছে।

‘এই স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করে বেশিরভাগ ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। স্পাইক প্রোটিনের গঠনগত বদলের জন্যই প্রচলিত ভ্যাকসিনেশনের পরও ওমিক্রন সংক্রমণের সম্ভাবনা থেকে যায়।’

ওমিক্রনে আক্রান্তদের দুই ডোজ টিকা দেওয়া ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এতে এটা প্রমাণ করে যে, ভ্যারিয়েন্ট নয়, টিকা নেওয়ার জন্য রোগের প্রখরতা কম হয়েছে। তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে, এরকম রোগীরও ওমিক্রন পাওয়া গেছে।

‘হাসপাতালে ভর্তি রোগী জিনোম সিকোয়েন্স করে আমরা ৬৫ শতাংশ রোগীতে ওমিক্রন এবং ৩৫ শতাংশ রোগীতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পেয়েছি। মৃদু উপসর্গের কারণে ওমিক্রন আক্রান্ত রোগীদের থেকে দ্রুত সংক্রমণ প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম মাথাব্যথা ও সর্দির মতো উপসর্গ হয়। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা কম।’

অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই গবেষণা জিনোমিক ডাটাবেজ থেকে বাংলাদেশে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে সম্ভবনা সৃষ্টি করেছে। প্রত্যেক করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট বিপদজনক এবং তা মারাত্মক অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

‘পাশাপাশি ভাইরাসের নিয়মিত মিউটেশন আমাদের প্রচলিত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে। তাই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, টিকাও নিতে হবে।’

ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বিএসএমএমইউ ২০২১ সালের ২৯ জুন থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা করে আসছে। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ওপর এ গবেষণা করা হয়।

গবেষণায় বাংলাদেশের সব বিভাগের ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ স্যাম্পলিং’ করা হয়। গবেষণায় ৯৩৭ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীর ন্যাযোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব স্যাম্পল থেকে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয় এবং জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের সঙ্গে রোগীর তথ্য-উপাত্তও বিশ্লেষণ করা হয়।

বিএসএমএমইউর গবেষণায় ৯ মাস থেকে শুরু করে ৯০ বছর বয়স পর্যন্ত রোগী অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৩০-৫৯ বছর বয়সী রোগীদের সংখ্যা বেশি। শিশুদের মধ্যেও কোভিড সংক্রমণ পাওয়া গেছে। পুরুষ ও নারীদের আক্রান্তের হার প্রায় সমান- ৪৯ শতাংশ পুরুষ ও ৫১ শতাংশ নারী।

কোভিড আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যাদের কো-মরবিডিটি রয়েছে, যেমন- ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, শ্বাসতন্ত্রের রোগ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস- তাদের রোগের প্রকটতা বেশি।

কোভিড-১৯-এর জিনোম সিকোয়েন্সিং বিশ্লেষণ গবেষণায় দেখা যায়, ২০২১ সালের জুলাইয়ে মোট সংক্রমণের প্রায় ৯৮ শতাংশ ছিল ইন্ডিয়ান বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ১ শতাংশ ছিল সাউথ আফ্রিকান বা বেটা ভ্যারিয়েন্ট। আর বাকি ১ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে পাওয়া যায় মরিসাস ভ্যারিয়েন্ট বা নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট।

২০২১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জিনোম সিকোয়েন্সে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৯৯.৩১ শতাংশ ছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। এছাড়া ছিল একটি করে ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন- আলফা বা ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং বেটা বা সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। অন্য একটি স্যাম্পলে শনাক্ত হয় 20B ভ্যারিয়েন্ট, যা SARS-COV-2 এর একটি ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট। গবেষণায় প্রধানত ডেল্ট ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ৮টি সাব-ভ্যারিয়েন্ট ধরা পড়েছে। সেগুলো হলো- AY.122, AY.122.1,AY.131, AY.26, AY.29, AY.30, AY.39, AY.4|

উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, SARS-CoV-2- এর জিনোমের গঠন উন্মোচন ও পরিবর্তনের ধরন এবং বৈশ্বিক কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে এর আন্তঃসম্পর্ক বের করা, ভাইরাসের বিবর্তনীয় সম্পর্ক, রোগের উপসর্গ, রোগের প্রখরতা, তুলনামূলক হাসপাতাল অবস্থানের মেয়াদ ও বাংলাদেশি কোভিড-১৯ জিনোম ডাটাবেস তৈরি করাই এই জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণার উদ্দেশ্য।

আন্তর্জাতিক সিকোয়েন্সিং ডাটাবেজজিন ব্যাংকে বিএসএমএমইউ-এর ৯৩৭টি ভাইরাল জিনোম জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জিনোমিক ডাটাবেজে বিএসএমএমইউর এই গবেষণা ফল ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রেও বৈজ্ঞানিক অবদানের একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।’

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে অজানা রোগ শনাক্তের খবর জানানো হয়। পরে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সে রোগের নাম দেন কোভিড-১৯। বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা শনাক্তের খবর জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। এরপর প্রথম মৃত্যুর খবর জানায় ১৮ মার্চ।