logo
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:১৯
পণ্যের দামে নাভিশ্বাস
রাজন ভট্টাচার্য/জুনায়েদ হোসাইন

পণ্যের দামে নাভিশ্বাস

দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে সয়াবিন তেলের দাম। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত। লাভের মধ্যেও পানির দাম বাড়াতে চায় ঢাকা ওয়াসা। শীত মৌসুমে সবজির বাজার কম থাকা স্বাভাবিক। তাই এই মৌসুমে বেশি শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস কমবেশি সবার। এ বছর এতেও গুড়েবালি। কারণ মৌসুম শেষেও সবজির বাজার হাতের নাগালে আসেনি।

খুচরা ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্রেতারা বলছেন, গেল ২০ বছরেও শীত মৌসুমে সবজির বাজার এত চড়া দেখা যায়নি। চালের বাজারে অস্থিরতা তো নতুন কিছু নয়। মৌসুমেও বাড়ছে চালের দাম। ইতোমধ্যে আড়তদাররা বৈশাখ মাসের বোরো ধান না কাটা পর্যন্ত চালের বাজার বাড়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

চিনির স্বাদ এখন আর অনেকের কাছে মিষ্টি নয়। দফায় দফায় দাম বেড়ে এ পণ্যের স্বাদ তিতোয় রূপ নিয়েছে। একসময় আটার ঠিকানা গরিবের ঘর হলেও এখন চিত্র বদলে সব শ্রেণির মানুষ আটা ভোগ করছেন। সেই আটাও এখন হাতের নাগালের বাইরে যাচ্ছে। গেল এক বছরে অন্তত তিনবার বেড়েছে এই পণ্যটির দাম।

এলপিজি ব্যবহারকারীদের চুলোয় নয়, যেন বুকে আগুন জ্বলছে। বারবার দাম বাড়ায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ এই জ্বলানি ব্যবহারকারীরা।

সব মিলিয়ে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর দাম গত ১২ বছরে বেড়েছে দুই থেকে আড়াই গুণ। দুর্বিষহ জীবনে পড়েছেন শ্রমিক, কৃষক থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও নিন্ম আয়ের মানুষ। বিনোদন, চিকিৎসা, লেখাপড়া এমনকি খাওয়ার খরচ কমিয়ে চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। এমনকি সরকারি কর্মচারীরাও।

শহরে থাকা মানুষের নতুন যন্ত্রণা হয়ে সামনে এসেছে বাড়তি বাড়ি ভাড়া। নতুন করে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর চেষ্টা অনেকের জীবন আরো বেশি দুর্বিষহ করে তুলবে বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে জীবন চলবে এ চিন্তায় সবার কপালে যেন ভাঁজ পড়েছে।

চলমান এই পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি যত্নশীল হয়ে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবীদ, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলছেন, নিত্যপণ্যের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি অনেক সময় সরকারের উপলব্ধিতে আছে বলে বোঝা যায় না। তাছাড়া অনেক সময় মন্ত্রীদের অনেকে দাম বাড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তি দেন। যদিও আমদানিনির্ভর পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের বাজারে কীভাবে তা সহনীয় রাখা যায় এটাই সরকারের কাজ।

বেসরকারি বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত ১১ বছরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে সরকারি গ্যাসের দাম। ২০০৯ সালে দুই চুলার গ্যাসের মাসিক বিল ছিল ৪০০ টাকা। পাঁচ দফায় বেড়ে তা হয়েছে ৯৭৫ টাকা। বৃদ্ধির হার ১৪৩ দশমিক ৭৫।

চলতি মাসে নতুন করে দুই চুলার গ্যাসের বিল ২ হাজার ১০০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো। ২০০৯ সালে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের খুচরা দাম ছিল চার টাকা ৩৪ পয়সা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা ৯৬ পয়সা, বেড়েছে ১২৯ শতাংশ। চলতি মাসে এই দাম ১১৭ শতাংশ বাড়ানোর আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা।

বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার আরো এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। গত ১১ বছরে ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। ২০১০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় খুচরা মূল্য ছিল তিন টাকা ৭৬ পয়সা। সর্বশেষ ২০২০ সালের মার্চে তা বাড়িয়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা করা হয়। এখন আরেক দফা দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) একটি যৌথ জরিপে সম্প্রতি বলা হয়েছে, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বেকার হয়েছে আড়াই কোটির বেশি মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির উদ্যোগ জনজীবনকে স্থবির করে দেবে। শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি কমবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিদ্যুৎ-জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি কৃষি, পরিবহণ, দ্রব্যমূল্য, শিল্প উৎপাদন থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজধানীর অন্তত পাঁচটি ট্রাক সেল ঘুরে দেখা গেছে, ভালো পোশাক আকাশে আসা লোকজনের ভিড় বেড়েছে অনেক। খিলগাঁও রেল গেট এলাকায় ট্রাক সেলের লোকজন জানান, আগের চেয়ে কয়েক গুণ ক্রেতা বেড়েছে। পণ্য কম হওয়ায় অল্প সময়ে শেষ হয়ে যায়। তাই অনেকেই খালি হাতে বাসায় ফেরেন।

রাজধানীর কাঁচাবাজারগুলোতে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। গতকাল বৃহস্পতিবার বাসাবো, সবুজবাগ, খিলগাঁও রেল গেট, সেগুন বাগিচা কাঁচাবাজার, মুগদা, মতিঝিল, হাতিরপুল, মগবাজারসহ অন্তত ১০টি বাজার ঘুরে পণ্যের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি।

কিন্তু কাঁচামালের দাম একেবারেই হাতের নাগালের বাইরে। প্রকারভেদে প্রতি কেজি বেগুন ৬০-৮০ টাকা বিক্রি হতে দেখা যায়, সিম ৫০-৭০ টাকা, জালি ৫০-৬০, পানি কদু ৭০-৮০ টাকা, কচুর মুখি ৮০ টাকা, জাম আলু ৪০ টাকা, দেশি লাল আলু ৩০ টাকা, পাতা কফি প্রতি পিস ৫০ টাকা, ফুলকফি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, গাজর ৩০ টাকা, টমোটো ৬০ টাকা, ঝিঙ্গা ৮০ টাকা এমনকি শাকের দামও বাড়তি।

মগবাজার কাঁচাবাজারের ক্রেতা মান্না জানান, করোনার থাবায় চাকরি গেছে। আয় বাড়েনি। অথচ দিন দিন খরচ বাড়ছে। গাফফার বলেন, কোভিডের প্রভাবে চাকুরিচ্যুত হয়ে বেশ কিছুদিন বেকার ছিলাম। সংসার চালাতে কম দামে বাসা নিয়েছি। সাত মাস বেকার থাকার পর নতুন চাকরি পেলেও বেতন কম। এর মধ্যে সবকিছুর যদি দাম বাড়ে তবে কীভাবে চলব জানি না।

পর্যাপ্ত উৎপাদনের পরও শীতের এই ভরা মৌসুমে সবজির দাম এত বেশি কেন- এমন প্রশ্ন তুলেছেন খোদ কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, এই সময় সবজির দাম কেন এত। একটা লাউ, একটা ফুলকপির দাম এত বেশি কেন? উৎপাদন তো কম হয়নি, এমন না যে, আবহাওয়া খারাপ ছিল। অবশ্য প্রথম দিকে সবজি লাগানোর পরে বৃষ্টির কারণে তা নষ্ট হয়েছে, এটাও বিবেচনায় নিতে হবে।’

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, মহামারি করোনার কারণে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। চাকরি ও ব্যবসা হারিয়ে দেশে বেকারের সংখ্যা কয়েক কোটি। এমন বাস্তবতায় সংসার চালাতে সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। আবার প্রতিদিনই দ্রব্যমূল্য বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ, রাজধানীর অনেকেই প্রতি মাসে পানির বিল দিয়ে প্রয়োজনমতো পানি পাচ্ছেন না।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, সাধারণ মানুষ ভালো নেই। আমরা সব সময় বলে আসছি। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা লাগামহীন হয়ে গেছে। সব কিছু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। এর পেছনে বড় কোনো যুক্তি দেখাতে পারছে না।

আমি বলব, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি, তা নিত্যপণ্য হোক আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক হোক, কোনো কিছুর দাম বাড়া ন্যায্যতার মানদণণ্ড গ্রহণযোগ্য না।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ভোরের আকাশকে বলেন, সমস্যাটা যতটুকু অভ্যন্তরীণ তার থেকে বেশি হচ্ছে বৈশ্বিক। বিশ্বের সব দেশে দাম বেড়েছে, সব দেশেই মূল্যস্ফীতির ছাপ সৃষ্টি হয়েছে। যেসব দেশে এর হার শূন্য ছিল সেখানেও ৭ বা ৮ শতাংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে হয়তো ততখানি প্রতিফলন হচ্ছে না, তবে এটি আগামীতে আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে নিত্যপণ্যের বাজার তথা সবজির বাজার শীত থাকার পরও বাড়তি হওয়া কিছুটা চিন্তার কারণ বলে জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে স্থানীয় কৃষক দাম পাচ্ছেন কি না সেই প্রশ্ন তোলেন এই বিশ্লেষক।