বিদায়ী বছরের বেশির ভাগ সময় পুঁজিবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো থাকলেও শেষদিকে এসে ছন্দপতন ঘটে। হঠাৎ করেই ধরাবাহিকভাবে সূচকের পতন শুরু হয়। লাগাতার কমতে থাকে শেয়ার ও ইউনিটদর। এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ নিয়ে দোলাচলে পড়েন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে অনেকেই শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি তুলে নিতে শুরু করেন। একই সঙ্গে তুলে নিতে থাকেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। পুঁজিবাজারে তাদের নিট বিনিয়োগ কমতে থাকে। যা বর্তমানে অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে গত চার মাসে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমেছে প্রায় তিন শত কোটি টাকা। অথচ এ সময়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে টানার জন্য দেশে দেশে রোড শোর আয়োজন করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে দুবাই, আমেরিকা, সুইজারল্যান্ড ও লন্ডনে রোড় শো সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর তেমন ফল দেখা যায়নি। আগামীতে আরো বেশ কিছু দেশে রোড শোর আয়োজন করেছে বিএসইসি।
এদিকে রোডশোর মাধ্যমে বিনিয়োগকারী বা বিনিয়োগ টানার চেষ্টার উল্টো ফল নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ বলছেন রোডশোর সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি মেলানো ঠিক হবে না। রোড শোর ফল পেতে সময় লাগবে। তবে অনেকে বলছেন রোডশো করার চেয়ে বাজারে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাজার স্থিতিশিল থাকলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পুঁজিবাজারে ভালোমানের শেয়ারের অভাব রয়েছে। তাই সবার আগে এখানে ভালো শেয়ারের জোগান বাড়তে হবে। ভালো কোম্পানি বাজারে আনার চেষ্টা করতে হবে। বাজারে ভালো শেয়ার না থাকলে রোডশো তেমন কাজে আসবে না। কারণ বিদেশিরা অনেক বুঝেশুনে বিনিয়োগ করেন। কারও কথা শুনে বা আবেগের বশে তারা বিনিয়োগ করেন না। বিষয়টি মাথায় রেখে যত দ্রুত সম্ভব ভালো শেয়ারের জোগান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাজার যাতে স্থিতিশীল থাকে সে চেষ্টা করতে হবে। তাহলে সব ধরনের বিনিয়োগ বাড়বে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে জানুয়ারি মাসে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমেছে ২৩ কোটি টাকার বেশি। এ সময়ে তারা প্রধান পুঁজিবাজার ডিএসই থেকে ১৫৪ কোটি ১৮ লাখ টাকার শেয়ার কিনেছেন। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ১৭৭ কোটি ২৭ লাখ টাকার শেয়ার। অর্থাৎ বছরের প্রথম মাসে তারা যত টাকার শেয়ার কিনেছিলেন তার থেকে ২৩ কোটি বেশি মূল্যের শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ সময় মোট ৩৩১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন করেছেন তারা। একইভাবে নভেম্বর মাসে বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ কমতে দেখা যায় ১১৩ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে ৯০ হাজার প্রবাসী ও বিদেশি বিনিয়োগকারী ৯৪৬ কোটি পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে ৫২৯ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন তারা। বিপরীতে শেয়ার কিনেছেন ৪১৬ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ১১৩ কোটি টাকার নিট বিনিয়োগ কমেছে। অর্থাৎ বিদেশিরা বাজার থেকে এ টাকা তুলে নিয়েছেন।
এদিকে গত বছরের অক্টোবরে বিদেশিদের মোট ৩৭২ কোটি ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল। এর মধ্যে তারা ২৮৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করেছেন। বিপরীতে মাত্র ৮৮ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার কিনেছেন তারা। অর্থাৎ অক্টোবরে ১৯৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
অর্থাৎ অক্টোবর, নভেম্বর ও জানুয়ারি- এ তিন মাসে নিট বিনিয়োগ কমেছে ৩৩২ কোটি টাকা। তবে ডিসেম্বরে বিদেশিদের বিনিয়োগ কিছুটা বাড়তে দেখা যায়। ওই মাসে তারা মোট ৩৪৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেন। এর মধ্যে ক্রয় ছিল ১৯৪ কোটি ২০ লাখ টাকার। বিপরীতে বিক্রি ছিল ১৫৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। অর্থাৎ বিক্রির তুলনায় ৩৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার শেয়ার বেশি কিনতে দেখা যায়। যে কারণে চার মাসে নিট বিনিয়োগ কিছুটা কমে (ডিসেম্বরের ৩৯ কোটি বাদ দিয়ে) ২৯৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারদর অতি মূল্যায়িত হওয়ায় বিদেশিরা তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর বড় কারণ হলো, পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব। এ কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিদেশিরা পুঁজিবাজারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোরতায় বাজারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান। এ কারণে তারা দেশি বড় বিনিয়োগকারীদের মতোই শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছেন।
বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির বিষয়ে তত্ত্ববধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, পুঁজিবাজারের বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির দ্বন্দ্ব রয়েছে। ফলে বাজারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিদেশিরা সন্দিহান। এছাড়াও দেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ করা গেছে। এ অবস্থায় বিদেশিদের কেউ কেউ মার্কেট পর্যবেক্ষণ করছেন। আবার কেউ কেউ শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা পুঁজির নিরাপত্তার কথা ভাবছেন।
অন্যদিকে বিষয়টি নিয়ে কথা বললে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী ভোরের আকাশ বলেন, ডলারের দাম বাড়লে সাধারণত পুঁজিবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমে। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে তারা শেয়ার বিক্রি করে থাকেন। সে কারণে তাদের বিনিয়োগ কমেছে। আশা করছি দ্রুতই তাদের বিনিয়োগ আবার বাড়বে।