logo
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৫৫
এক বছরে বিয়েবিচ্ছেদ বেড়েছে ২২%
নাজমুল হাসান রাজ

এক বছরে বিয়েবিচ্ছেদ বেড়েছে ২২%

বেপরোয়া জীবনযাপন করেন কামাল (ছদ্মনাম) এমন দাবি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী আকলিমার (ছদ্মনাম) দুজনেই থাকেন যাত্রাবাড়ীর কাজলা নয়ানগর এলাকায়। স্বামী কামাল প্রায়ই স্থানীয় বাবুলের চায়ের টং দাকানে সময় দেন। তার মন ভালো নেই বলে দীর্ঘ সময় আড্ডায় মেতে থাকা মানুষটার স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চার বছর। মহামারি করোনায় তার চাকরি চলে গেলে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ার দ্বন্দ্ব পৌঁছায় চরমে। দুজন আলাদা হন সংসার ভেঙে প্রায় বছর পার করেছে। সংসার ভাঙার মূল দায় কাঁধে নিতে রাজি নন কামাল। ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে কামালের স্ত্রী আকলিমার দায় স্বামীর ওপর। তিনি বলেন, আমরা দুজন ভালো বন্ধু ছিলাম। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় একই কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় পড়াকালীন বিয়ের পিঁড়িতে বসি। আকলিমার চোখের জ¦ল ছলছল করছে তবুও তিনি বলছেন, আমার সুখ দরকার নেই একা অনেক ভালো আছি, আর একাই থাকতে চাই। ডিভোর্সি জীবনযাপন নিয়ে তার মোটেও কষ্ট বা ক্ষোভ নেই আমার। ২০১৮ সালে ধুমধাম করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তানিমা; চার বছরের সংসারে তার ঘরে রয়েছে একটা কন্যা সন্তান; নাম রেকেছেন টুকটুকি। দেখতেও বেশ সুন্দর মায়ের মতোই হয়েছে। সংসারে বনিবনা না হওয়ায় করোনার মাঝামাঝি ২১ সালের শুরুতে আলাদা হয়ে যায় তার সংসার। একই সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ২০ ডিসেম্বর বিবাহ বন্ধনের ছিন্ন করে এখন বাবার বাড়িতে থাকেন। মূল সমস্যা দাম্পত্য জীবনে কলহই বলে মনে করেন তানিমা। কেমন কাটছে তার বর্তমান জীবন’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা হতাশা সব সময় কাজ করলেও খুব ভালো আছি তা বলব না।


বর্তমান সময়ে সমাজের শুধু কামাল, আকলিমা বা তানিমা নয় এরকম হাজারো স্বামী-স্ত্রীর সংসার জীবন আলাদা হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। বিবাহ বিচ্ছেদের সমস্যার মূল অভিযোগগুলোর মধ্যে’ পুরুষদের মূল অভিযোগ স্ত্রীর পরকীয়া আর মেয়েদের উচ্চভিলাষী জীবন ধারণ, বেপরোয়া জীবনযাপন, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, স্ত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই স্বামীদের প্রতি। স্বামীরা তাদের সময় না দেওয়া স্ত্রীর নির্যাতন, যৌতুক, মানসিক পীড়ন, পরকীয়া, আর্থিক সমস্যা, মাদকাসক্ত, পুরুষত্বহীন ও ব্যক্তিত্বের সংঘাত, অন্যের স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ দেখানো, বদমেজাজি, সন্তান না হওয়া অবাধ্য হওয়া ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী জীবন ব্যবস্থা মেনে না নেওয়াসহ একাধিক সমস্যা।


দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে মোট বিবাহবিচ্ছেদ ১১ হাজার ৭৮৭ জনের। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ১১ হাজার ৯১৯ জনের। উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪ হাজার ৬৭৪ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭ হাজার ২৪৫ জন। এক বছরে তালাকের পরিমাণ বেড়েছে ২ হাজার ১৩২ জন। শতাংশের হিসাবে যা বেড়েছে ২২ ভাগ। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাকের নোটিশ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের কার্যালয়ে পাঠানোর বিধান রয়েছে। প্রথমে মেয়রের কার্যালয়ে তালাকের আবেদন নথিভুক্ত হয়। তারপর সেখান থেকে আবেদন মূলত স্ত্রী কোন অঞ্চলে বসবাস করছেন, সেই অনুযায়ী ওই অঞ্চলের কার্যালয়ে (সিটি করপোরেশনের) পাঠানো হয়।


তালাকের অর্থ্যাৎ নথি বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনে স্বামীদের তুলনায় সংখ্যায় বেশি স্ত্রীরা। গত এক বছরে স্ত্রীদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন ছিল ৭১ ভাগ। অন্যদিকে স্বামীরা বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেছেন ২৯ ভাগ। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তালাকের আবেদন জমা পড়ে ৯ হাজার ৭৮৭টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ৩ হাজার ৪৪২ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬ হাজার ৩৪৫ জন। তবে ওই বছরের এপ্রিল মাসে সারা দেশে লকডাউন চলায় তালাকের কোনো আবেদন জমা পড়েনি। অন্যদিকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ১১ হাজার ৯১৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা প্রতিদিন তালাকের ঘটনা ঘটছে ৩৩টি। অর্থাৎ প্রতি দুই ঘণ্টায় প্রায় তিনজনের বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে, যা শতাংশের হিসাবে গত এক বছরে প্রায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীরা আবেদন করেছেন ৯ হাজার ২৬৪ জন। একই সময় স্বামীরা আবেদন করেছেন ৩ হাজার ৮২৪ জন। অর্থাৎ মোট বিবাহবিচ্ছেদের ৭১ ভাগ স্ত্রীরা আবেদন করেছেন। পক্ষান্তরে স্বামীরা আবেদন করেছেন ২৯ ভাগ।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক যুগ ধরে মেয়েদের তালাকের আবেদনের প্রবণতা বেড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বাস্তবতা এবং প্রতিযোগিতার সঙ্গে টিকে থাকতে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এখন প্রতিযোগিতামূলক সমাজ। মানুষের আকাক্সক্ষা অনেক বেশি। এই আকাক্সক্ষা আদি সমাজের সঙ্গে বর্তমান সমাজের পার্থক্য তৈরি করেছে। অথচ আগে যুগের পর যুগ সংসার টিকে থাকত। একটা পরিবার গড়ে ওঠে একজন পুরুষ এবং নারীর বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই প্রজন্মের পর প্রজন্মের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এখন কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার পার্থক্য, প্রতিযোগিতার সঙ্গে নিজেকে চালিয়ে যাওয়া এবং সেগুলোর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পাড়ায় নারী-পুরুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে।