logo
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:০২
রাজধানীতে বাড়ছে হাতপাতা মানুষ
নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে বাড়ছে হাতপাতা মানুষ

রাজধানীর বাসাবো বৌদ্ধ মন্দিরের ঢালে প্রায় প্রতিরাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে একজন অসহায় বৃদ্ধ নারীকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। বয়স কমপক্ষে ৭০-এর বেশি। বয়সের ভারে কোমড় বাঁকা হয়ে মাটিতে লাগে লাগে অবস্থা। ডান হাতে লাঠি ভর করে কোনো রকম চলেন। বাম হাতে একটি প্লাস্টিকের বাটি হাতে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাউকে কিছু বলার সাধ্য নেই তার, টাকাও চান না। নিজের নামটাও পর্যন্ত বলতে পারেন না। তার চলার ভঙ্গিমাই বলে দেয় অর্থের প্রয়োজনে পথে নেমেছেন তিনি। অনেক কষ্ট করে ধরে রাখা বাটিতে সবাই কমবেশি টাকা দিয়ে যান। এভাবেই জীবনের প্রয়োজনে প্রতি রাতে পথে নামতে হচ্ছে অসহায় এই বৃদ্ধাকে।


স্থানীয় লোকজন বলছেন, করোনা শুরুর পর থেকেই অসহায় এই বৃদ্ধাকে প্রায় প্রতি রাতে বৌদ্ধ মন্দিরের সামনের রাস্তায় দেখা যায়। তিনি কোথা থেকে আসেন, কারা এখানে দিয়ে যান কেউ বলতে পারেন না। তার এই অসহায় অবস্থা দেখে কমবেশি সবাই আর্থিক সহযোগিতা করেন। রাজধানী রাজপথ থেকে অলিগলি পর্যন্ত এখন হাতপাতা মানুষের অভাব নেই। করোনা শুরুর পর থেকে অসহায় মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। জীবনের প্রয়োজনে তাই পথে নেমেছেন অনেকেই। বিশেষ করে নারী ভিক্ষুকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এদের একটা অংশ কাজ বঞ্চিত, আরেকটি অংশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জীবন চালাতে ঢাকায় এসে হাত পাতছেন।


কেউ চিকিৎসার প্রয়োজনে, কেউবা সন্তানের খাবার, কেউ নিজের প্রয়োজনে টাকা চাচ্ছেন। এখন এই শহরের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে দাঁড়ালে ঘণ্টায় অন্তত ১০ জন মানুষ টাকা চাইতে আসেন না। খিলগাঁও রেলগেট এলাকার ফুটপাতে প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত অবধি দুই শিশুকে ঘুম পারিয়ে এক অসহায় মাকে ভিক্ষা চাইতে দেখা যায়। তেমনি নিউ ইস্কাটনের এইচপিআরসি হাসপাতালের সামনের ফুটপাতে একই রকম চিত্র দেখা যায়। টাকার জন্য অনেকেই সাধারণ মানুষকে হাতে পায়ে পর্যন্ত ধরতে দেখা যায়।


গত ৪ জানুয়ারি ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচির জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয়। ওই সভায় নেতৃত্ব দেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহম্মদ। এতে জানানো হয়, দরিদ্রতা, নদীভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ-বালাই, প্রতিবন্ধিতাসহ দুষ্টচক্রের অর্থ লালসা, ভিক্ষাবৃত্তিতে অর্থ উপার্জনের সহজলভ্যতার কারণে দেশের বড় শহরগুলোতে ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। শহরের প্রধান প্রধান সড়ক, ফুটপাত, ট্রাফিক সিগন্যাল, বিপণিবিতান ও বাজার, অফিস চত্বর, মসজিদ ও জনবহুল স্থানে বিভিন্ন বয়সি পুরুষ, নারী ও শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ও শিশু।


সভার কার্যপত্র থেকে আরো জানা যায়, সভায় ভিক্ষুকমুক্ত হিসেবে ঘোষিত সাতটি এলাকাসহ রাজধানীর ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য দ্রæত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই সঙ্গে নির্মিত হবে টিনশেড ডরমিটরি। থাকবে প্রশিক্ষণ ও দারিদ্র্যবিমোচন সংশ্লিষ্ট ঋণের ব্যবস্থা।


২০১৯ সালের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে শিগগির আটটি বিভাগীয় পর্যায়ে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণে উপযোগিতা নির্ধারণে সমীক্ষা ও সমীক্ষার ফলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে বলেও ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়।


২০১০ সালে ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করে সরকার। সিদ্ধান্ত হয়, প্রথমে রাজধানী ঢাকা হবে ভিক্ষুুকমুক্ত। সেটা ২০১৩ সালের কথা। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন করা হয় ঢাকার সাত এলাকা। এরপর কেটে গেছে ৯ বছর। তবে ঢাকা শহর দূরে থাক, নির্ধারিত সাত এলাকাও এখনো ভিক্ষুকমুক্ত হয়নি। গোটা শহরের হিসাব ধরলে ভিক্ষুক বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ধরলেও রয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র সংকট। দুই-চারজনকে অন্য পেশায় ফেরালেও কৌশলে তারা আবার ফিরছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে।


ঢাকাসহ সারা দেশে ভিক্ষুক পুনর্বাসনে কাজ করে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তর। তাদের বক্তব্য, বহু পুরোনো জরাজীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। সমাজসেবা বিভাগের রয়েছে জনবল সংকট। ভিক্ষাবৃত্তিকেন্দ্রিক চক্র, অপ্রতুল বরাদ্দ, সচেতনতার অভাব ও সমন্বয়হীনতার কারণেই মূলত ভিক্ষুকমুক্ত করা যাচ্ছে না। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সম্প্রতি রাজধানীতে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়লেও পরিস্থিতি বিবেচনায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে।


সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রকৃতপক্ষে দেশে ভিক্ষুকের কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, সারা দেশে আড়াই লাখের মতো ভিক্ষুক আছেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভিক্ষুকমুক্ত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পুনর্বাসনের জন্য বিপুল সংখ্যক ভিক্ষুককে আটক করা হলেও ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা না থাকায় তাদের ছেড়ে দিতে হয়। চলতি অর্থবছর মাত্র ১৪০ ভিক্ষুককে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের রয়েছে জনবল সংকট।


সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহফুজা আখতার বলেন, ‘ভিক্ষুক পুনর্বাসনে বরাদ্দ আগের অর্থবছর ৫ কোটি টাকা থাকলেও চলতি অর্থবছর ৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। আমরা ডিসিদের মাধ্যমে পুনর্বাসন কার্যক্রম করি। দেখা যায়, আমরা কোনো ভিক্ষুককে প্রশিক্ষণ দিয়ে একটা উপকরণ যেমন- ঠেলাগাড়ি কিংবা রিকশা দিয়ে পুনর্বাসন করলাম। তিনি এটি বিক্রি করে কিংবা কোনো আত্মীয়কে দিয়ে ঢাকায় এসে আবার ভিক্ষা করেন।’


ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূলে ‘ ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান নীতিমালা-২০১৮’ করা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, যেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন কমিটি, পৌরসভা কার্যক্রম বাস্তবায়ন কমিটি, সিটি করপোরেশন অঞ্চলভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তহবায়ন কমিটি, বিভাগীয় ও জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে এ কমিটিগুলোর নির্দিষ্ট কার্যক্রম/কর্মপরিধি নির্ধারণ করা আছে।’


সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভিক্ষুকের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রবেশপথে, রিকশা বা বাসস্ট্যান্ড, বাসের ভেতরে ব্যাপকহারে বেড়েছে ভিক্ষুক। ফুটওভার ব্রিজগুলোতেও ব্যাপক সংখ্যক ভিক্ষুকের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। কার্যত কোথাও ভিক্ষুক কমেছে এমনটি চোখে পরেনি।


চলতি বছর ভিক্ষুক পুনর্বাসনে ৬৪ জেলার জন্য ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর আগের অর্থবছর বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের ৫৮টি জেলা থেকে জেলা প্রশাসক ও সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালকদের যৌথ স্বাক্ষরিত চাহিদাপত্রে ২ লাখ ৩ হাজার ৫২৮ জন ভিক্ষুককে পুনর্বাসনের জন্য ৪২২ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয় ৩ বছর বরাদ্দ পাওয়া যায় ৩ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়। পরের বছর বরাদ্দ ছিল (২০১৯-২০) ৩ কোটি ৭ লাখ টাকা। ভিক্ষুক পুনর্বাসনে এই বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।


সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা অধিশাখার উপপরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠী) মো. শাহ জাহান বলেন, ‘ ভিক্ষুকদের ভিক্ষাবৃত্তি থেকে নিবৃত করতে আমরা প্রায় প্রতিদিনিই মোবাইল কোর্ট চালাচ্ছি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। কিন্তু আশ্রয়কেন্দ্রে স্থান অপ্রতুল হওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়ছি।


সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধলা, গাজীপুর পুবাইল, নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, গাজীপুরের কাশিমপুর, মানিকগঞ্জের বেতিলা ও ঢাকার মিরপুরে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করায় ২০১৭ সাল থেকে মানিকগঞ্জের আশ্রয়কেন্দ্রটি ব্যবহৃত হচ্ছে না। এই ছয়টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ৯০০ জনের আসন থাকলেও এখন রয়েছেন ৮০০ জনের মতো।