logo
আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:৩৮
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র উন্মাদ, কিন্তু কেন?

ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র উন্মাদ, কিন্তু কেন?

ন্যাটোর পরিধি বাড়ানো নিয়ে সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পশ্চিমারাও পূর্ব ইউরোপে সেন্যসংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। সেই সঙ্গে জড়ো করছে অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র। একই সঙ্গে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে যুদ্ধের। আতঙ্ক ছড়িয়ে ইতোমধ্যেই কিয়েভ থেকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। ভাবনাটা এই যে, যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি ইউক্রেনও ভালো চোখে দেখছে না। পশ্চিমাদের এই আতঙ্ক ছড়ানো ইউক্রেন রীতিমতো অস্বস্তিতে রয়েছে। এবং এ বিষয়ে কিয়েভ মুখও খুলছে। কিয়েভের কর্তৃপক্ষ বলেছে, আমরা আতঙ্ক চাই না। সীমান্তে রুশ সৈন্য মোতায়েন নিয়ে কিয়েভের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, গত বসন্তেও ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এ বিষয়ে কিয়েভের এক শীর্ষ কূটনীতিক বলেছেন, যুদ্ধ হবে বলে পশ্চিমা কূটনীতিকরা বারবার সতর্কতা বার্তা দিচ্ছেন। এমনকী রাষ্ট্রপ্রধানরাও যুদ্ধের সংকেত দিচ্ছেন। এটা আতঙ্ক। এই কূটনীতিক আরো বলেন, ইউক্রেনের বড় হুমকি দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির অস্থিতিশীলতা।

উল্লেখ্য, ইউক্রেন দেশের ভিতর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সশস্ত্র হুমকির মুখে রয়েছে। এ নিয়ে কয়েক বছর আগে ইউক্রেন সৈন্যদের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়েছে। রাশিয়ার সহযোগিতায় সেই লড়াইয়ের আপাত অবসান হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চলছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেনের ডানবাস প্রদেশের অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্দোলন করছেন। কিন্তু কিয়েভ কর্তৃপক্ষ তাদের দাবিতে কর্ণপাত না করায় তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় সরকারকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। ফলে এক রক্তক্ষয়ী লড়াই হয়। ওই লড়াই শেষ পর্যন্ত হস্তক্ষেপে শান্ত হয়। এ অবস্থায় ইউক্রেন কিভাবে তার জাতিগত-ভাষাগত সমস্যার সমাধান করবে সেটাই বড় প্রশ্ন। কারণ এর ফলে ইউক্রেনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমারা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সম্প্রসারণের নামে ইউক্রেনে সামরিক খাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়ে ইউক্রেনকে যুদ্ধাবস্থার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। পরিস্থিতি এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, রাশিয়ার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দীর্ঘদিনের ঠান্ডা লড়াই শেষ হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেমে নেই। এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোকে সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই পূর্ব ইউরোপের ছোট-বড় বেশ কয়েকটি দেশকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন টার্গেট ইউক্রেন। ইউক্রেন রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ এবং সে দেশে নানামুখী অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সঙ্গে একটা বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে টোপ দিয়ে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করে রাশিয়ার সীমান্তে ঘাঁটি স্থাপন করতে চায়। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি রাশিয়ার জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য প্রশ্ন। মস্কো সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, রাশিয়ার সীমান্তসহ পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়া মেনে নেবে না। প্রয়োজনে ন্যাটোর সঙ্গে টক্কর দেবে, দিচ্ছেও। আর এতেই শুরু হয়েছে সংকট। ইউক্রেন সংকট। শুরু হয়েছে যুদ্ধাবস্থা। এই যুদ্ধাবস্থাকে উসকে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রুশ হামলা নিশ্চিত করতে চায়। আর সত্যিই যদি রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁদে পা দেয়, তাহলে ইউক্রেনে মার্কিন ঘাঁটি নিশ্চিত হয়। কয়েক মাস ধরে তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একের পর এক হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন রাশিয়াকে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে তার পশ্চিমা মিত্ররা হুমকি দেওয়া শুরু করেছে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ইরাক যুদ্ধের সময়। ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার তাঁবেদার তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে দিয়ে ইরাককে একের পর এক হুমকি দিয়ে পশ্চিমা শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে। ইরাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, ইরাক মারাত্মক সব রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র মজুত করেছে। এই অস্ত্র বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক। শেষ পর্যন্ত এই অভিযোগ করে ইরাক আক্রমণ ও দখল করে এবং ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে। একইভাবে লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করে লিবিয়া দখল ও গাদ্দাফিকে হত্যা করে। কিন্তু লিবিয়া, ইরাক আর রাশিয়া এক নয়। রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকার বহন করছে। সাবেক সোভিয়েত পরাশক্তির উত্তরসূরি। রাশিয়ার কাছে আছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, আছে হাজার হাজার পরমাণুু বোমা ও পরমাণুুচালিত সাবমেরিন এবং সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র। ব্যালেস্টিক মিসাইল। এ অবস্থায় রাশিয়াকে আন্ডার ইস্টিমেট করা স্রেফ পাগলামি। পাগলামি নয়, রীতিমতো মূর্খতা।


মনে রাখতে হবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সোভিয়েত লাল ফৌজ হিটলারের জার্মান ফৌজকে পরাজিত করে বার্লিন দখল করে। বার্লিন দখল করে সেখানে সৌভিয়েত ইউনিয়নের কাস্তে-হাতুড়িখচিত রক্তলাল পতাকা উত্তোলন করে জার্মানসহ ইউরোপ তথা বিশ^কে ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে রক্ষা করে। তারই বদৌলতে আজ ইউরোপের শান্তি ও স্থিতিশীলতা। যে লাল ফৌজের হাতে হিটলারের পতন হয়, সেই লাল ফৌজেরই উত্তরসূরি রুশ সেনা। তাই রুশ সেনার যোগ্যতা নিয়ে, তাদের যুদ্ধের কৌশল নিয়ে দুর্বলতার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, তারপরও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাশিয়াকে একের পর এক হুমকি দিয়েই চলেছেন। এমনকি রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণা দিয়েছেন পুতিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও পরিবারবর্গের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের।


৩১ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, আমরা রাশিয়ার অভিজাত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারবর্গের সদস্যদের জন্য সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্যাকেজ তৈরি করে ফেলেছি। ইউক্রেনে হামলা হলেই এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বলেন, ইউক্রেনে হামলা হলে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে হোয়াইট হাউস প্রস্তুত। ফলে পরিস্থিতি এখন খুবই উত্তপ্ত।

সর্বশেষ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও কোনো কাজ হয়নি। ৩১ জানুয়ারি নিরাপত্তা পরিষদে বৈঠক শেষ হয়েছে রুশ ও মার্কিন কূটনীতিকদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও বাগবিতণ্ডার মধ্য দিয়ে। বৈঠকে রুশ প্রতিনিধি সুস্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া বিষয়ে উন্মাদ হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য হস্তক্ষেপ করছে। রুশ প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া আরো বলেছেন, রাশিয়া প্রায়ই তাদের নিজেদের দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনা মোতায়েন করে। তা পর্যালোচনা করা ওয়াশিংটনের কাজ নয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রও বিভিন্ন সময় তার দেশে, এমনকি ভিনদেশে সেনা মোতায়েন ও সেনা মহড়া করে। এক্ষেত্রে রাশিয়া ভিনদেশে নয়, নিজ দেশে নিজ ভূখণ্ডে সেনা মোতায়েন করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা কেন এ প্রশ্ন কেন করা হচ্ছে না। পশ্চিমা বিশ্বের এ প্রশ্নে কেন নিশ্চুপ তা বোধগম্য নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, পশ্চিমা বিশ্বের সবাই বেকুব নয়। তারা তাদের বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ করছে এবং সেইভাবে যে যার মতো সিদ্ধান্ত নেবে। সর্বোপরি, একটা যুদ্ধের বিপদ পশ্চিমা বিশ্বের ভালো করে বোঝে। ভালো করেই বোঝে যুদ্ধ যদি হয়, প্রতিপক্ষ রুশ সেনা। এ ছাড়াও আর্থিক প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের মার্কিন মদদে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে। বিশেষ করে জ্বালানি সংকট দেখা দেবে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহে জ্বালানির ৪১ ভাগ সরবরাহ আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে ইউরোপে বিপর্যয় দেখা দেবে। ইতোমধ্যে ইউরোপের অনেক দেশ বিষয়টি উপলব্ধি করতে শুরু করেছে।


হাঙ্গেরি বলেছেন ইউক্রেনে যুদ্ধ হলে ইউরোপের জ্বালানি সংকট দেখা দেবে। তাই তো মার্কিন আহ্বানকে প্রত্যাখ্যান করে জার্মানি ইউেক্রেনে অস্ত্রের বদলে শুধু হেলমেট পাঠিয়েছে। এমনকি ন্যাটো বাহিনীপ্রধান স্বয়ং বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরু হলে ন্যাটো বাহিনী যুদ্ধে অংশ নেবে না। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। এ অবস্থার মাঝেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের বক্তব্যই সঠিক। তিনি বলেছেন, তবে পরিস্থিতি যাই হোক, যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক সকল মিত্রকে এবার পাশে পাবে না যেভাবে পেয়েছিল লিবিয়া ও ইরাক যুদ্ধে। ইতোমধ্যে তার ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। তা ছাড়া ইউক্রেনের সুরক্ষায় ন্যাটোর প্রতিরক্ষা শক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে রাশিয়া। ন্যাটো জোটের বিভক্তি-বিভাজন সুস্পষ্ট তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে পুতিন। আসলে পুতিন কি চান তা স্পষ্ট হলেও তিনি তা কীভাবে আদায় করবেন, সেটা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।


আমাদের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্রের বোধদয় হবে। যুদ্ধের বিপদ থেকে তারা নিজেরা নিজেদের রক্ষা করবে এবং অন্যকে বিপদে ঠেলে দেওয়ার নীতি পরিত্যাগ করবে। অন্যথায় ইউরোপে মহাবিপদ দেখা দেবে। সেই বিপদ থেকে বিশ্বের কেউই রক্ষা পাবে না। রক্ষা পাবে না খোদ যুক্তরাষ্ট্রও। কারণ এখন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের যুগ। সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের যুগ। আর যদি বলেন সীমিত যুদ্ধ, সীমান্ত যুদ্ধ, প্রক্সিওয়ার হবে, তা হলে অন্য কথা। তবে এক্ষেত্রে প্রক্সিওয়ারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। রাশিয়া তার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আর যাই হোক প্রক্সিওয়ারে যাবে না। আর সীমিত ও সীমান্ত যুদ্ধ? না, মোটেও নয়। রুশ কূটনীতিকরা আর যাই হোক অজ্ঞ মূর্খ নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেনে ঘাঁটি গড়ার সুযোগ করে দেবে। এখন প্রশ্ন, তা হলে কি হবে? হলে সর্বাত্মক যুদ্ধ। যে যুদ্ধ মানবজাতির ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। যার দায়দায়িত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই বহন করতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক