কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপের চাপায় পাঁচ ভাই নিহতের ঘটনায় অভিযুক্ত চালককে রাজধানী থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। আটক পিকআপ চালকের নাম সাহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুল (২৩)।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি ইমরান খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, আটক সহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুল বান্দরবান জেলার লামা এলাকার মো. আলী জাফরের ছেলে। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই সে দু’বছর ধরে পিকআপ চালিয়ে আসছিল।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টায় কারওয়ান বাজারস্থ র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
আটক চালকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, ওইদিন সকালে ঘনকুয়াশা ছিল। এর ভেতরেই ঘণ্টায় ৬৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে পিকআপটি চালাচ্ছিল সে। দুর্ঘটনার পূর্বমুহূর্তে সে পথে দাঁড়ানো লোকদের দেখতে পেলেও গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় তাদের বাঁচাতে পারেনি। দুর্ঘটনার সময় পিকআপ মালিকের ছেলে তারেক তার সঙ্গে গাড়িতে ছিল। তারেকের নির্দেশে আহতদের উদ্ধার না করেই পালিয়ে যায় তারা।
এ ঘটনায় একই পরিবারের ৫ ভাই অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫) চম্পক সুশীল (৩০) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয় নিহতদের অপর সহোদর স্মরণ সুশীল (২৪), রক্তিম সুশীল এবং বোন হীরা সুশীলকে। এদের মধ্যে স্মরণ সুশীল (২৪) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। আর গুরুতর আহত রক্তিম সুশীল চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। বোন হীরা সুশীলও এখনও চিকিৎসাধীন।
বাবার শ্রাদ্ধ শেষে ঘরে ফিরছিলেন তারা। মহাসড়ক পার হওয়ার জন্য এক ধারে অপেক্ষা করার সময় দ্রুতগতির পিকআপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাদের সবাইকে চাপা দেয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয়সূত্রে জানা যায়, গত ৩০ জানুয়ারি নিহতদের পিতা সুরেশ চন্দ্র সুশীল বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। গত ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভোরে বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে পূজা শেষ করে তারা ৭ ভাই একবোন কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মালুমঘাট বাজারের কাছে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। এসময় কক্সবাজারমুখী বেপরোয়া গতিতে চলমান একটি পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মূলসড়ক থেকে নেমে গিয়ে তাদের চাপা দেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনায় নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল (২২) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পিকআপ চালককে আসামি করে চকরিয়া থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
তিনি জানান, গত ৮ ফেব্রুয়ারি একই পরিবারের ৫ সহোদরের মর্মান্তিক এই মৃত্যুর ঘটনাটি প্রথম থেকেই সংবাদ মাধ্যমগুলোতে গুরুত্বসহকারে প্রচারে দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব দুর্ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।
এরই ধারাবাহিকতায়, র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫ এর অভিযানে গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ঘাতক হিসেবে অভিযুক্ত পিকআপ চালককে আটক করা হয়। পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃত পিকআপের চালক সাইফুল নিহতদেরকে গাড়ি চাপা দেওয়ার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করে। আটককৃতের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় ঘাতক পিকআপের চাবি।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, আটককৃত সাইফুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে তারেক ও রবিউল নামক দুইজনসহ চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে সবজি বোঝাই পিকআপ নিয়ে সে রওনা করে। রাস্তায় অনেক কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও চালক সাইফুল দ্রুত কক্সবাজার পৌঁছে সবজি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেপরোয়া গতিতে পিকআপটি চালাচ্ছিল। বেশি কুয়াশা ও অতিরিক্ত গতির কারণে মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারতদেরকে চালক সাইফুল দূর থেকে লক্ষ্য করতে পারেনি। গাড়িটি দ্রুতগতির থাকায় পথের পাশে দাঁড়ানোদের খুব কাছাকাছি এসে সে দেখতে পেলেও গতি কমাতে না পারায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
র্যাব জানায়, দূর্ঘটনার সময় চালকের সঙ্গে ওই পিকআপের মালিকের ছেলে তারেক ও ভাগ্নে রবিউল ছিল।
সাইফুল আরও জানায়, গাড়িটি ঘণ্টায় ৬৫-৭০ কি. মি. গতিতে চলছিল এবং দূর্ঘটনার পূর্বমুহূর্তে চালক গাড়ি থামানোর জন্য ব্রেক করলেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ১০০ ফুটের মতো সামনে চলে যায়। পরবর্তীতে চালক পিকআপ থেকে নেমে নিহতদের দেখতে এলেও মালিকের ছেলে তারেকের নির্দেশে সে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
র্যাব কমান্ডার জানান, আটক পিকআপচালক সাইফুল এর কোন ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও দু’বছর ধরে সে পিকআপ, চাঁন্দের গাড়ি ও ভারী ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়ি চালাত। দূর্ঘটনার ১ সপ্তাহ আগে সে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে পিকআপটি চালানো শুরু করে। এর আগে সে বান্দরবানের লামাতে একটি রাবার বাগানে চাকরি করত বলে জানিয়েছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, দুর্ঘটনার পর সাইফুল মালুমঘাট বাজারের একটি স্থানে গাড়িটি থামিয়ে মালিককে ফোন করে ঘটনার বিষয়টি জানায়। গাড়িটির মালিক তাকে পিকআপটি পরবর্তী কোন এক স্টপেজে রেখে লোকাল বাসে করে এসে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী, আটককৃত সাইফুল ডুলাহাজরায় এসে পিকআপটি রাখে এবং লোকাল বাসে করে চকরিয়া গিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করে। পিকআপের মালিক মাহমুদুল তাকে ন্যূনতম এক বছর আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দিলে সে প্রথমে তার আগের কর্মস্থল বান্দরবানের লামার রাবার বাগানে আত্মগোপনে যায়। পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে অন্যত্র আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসে এবং রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা হতে র্যাবের হাতে আটক হয়।
তিনি আরও জানান, পিকআপের মালিক মাহামুদুল করিম কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানাধীন মালুমঘাট এলাকার শামছুল আলমের ছেলে। মূলত: তিনি সবজি পরিবহনের ব্যবসা করেন। তিনি চকরিয়ার সবজির আড়ত থেকে কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী এলাকায় সবজি সরবরাহ করে থাকেন। তার ছেলে তারেক সবজি সরবরাহের তদারকি করত এবং ভাগিনা রবিউল তারেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। তিনি ২০১৬ সালে পিকআপটি কেনেন। মূলত সবজি পরিবহনের উদ্দেশ্যেই পিকআপটি ব্যবহার করা হতো। গত ৪ বছর ধরে পিকআপের ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন এবং গত ৩ বছর ধরে রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। দুর্ঘটনার পর পিকআপের মালিক, তার ছেলে তারেক ও ভাগিনা রবিউল আত্মগোপনে রয়েছে।
আটককৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।