logo
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৫৮
সার্চ কমিটির সঙ্গে বিশিষ্টজনের বৈঠক
নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আগেই প্রকাশের দাবি
নিজস্ব প্রতিবেদক

নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে
পাঠানোর আগেই প্রকাশের দাবি

বিতর্ক এড়াতে সার্চ কমিটির কাছে জমা পড়া নামের তালিকা প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। বিশেষ করে প্রাথমিক এবং চূড়ান্ত বাছাইয়ে যাদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান নির্বাচন কমিকশনার অন্য কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করবে, তা আগেই প্রকাশ করতে হবে। এতে করে তালিকায় যদিও কোনো বিতর্কিত ব্যক্তির নাম আসে, তাহলে তা সংশোধনের সুযোগ পাওয়া যাবে। একই সঙ্গে সবার আস্থাভাজন ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের ব্যাপারে মতামত ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রায়ের মধ্য থেকেও ইসিতে নিয়োগের সুপারিশ এসেছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ পরিপস্থি কেউ যাতে ইসিতে স্থান না পান সে বিষয়ে মতামত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল শনিবার সার্চ কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনেরা এসব মতামত তুলে ধরেন। বেলা ১১টা থেকে সুপ্রিম কোর্ট জাজেস লাউঞ্জে দুই দফায় সার্চ কমিটির সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়। এতে প্রথম দফায় ১৪ জন এবং দ্বিতীয় দফায় ১১ জন অংশ নেন।


দুই দফায় তিন ঘণ্টা বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ইসি নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দল পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তি উদ্যোগে মোট ৩২৯ জনের নাম জমা পড়েছে। এর মধ্যে ২৪ রাজনৈতিক দল ১৩৬ জনের নাম প্রস্তাব করেছে। পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ৪০ জনের, ব্যক্তি উদ্যোগে ৩৪ এবং ই-মেইলের মাধ্যমে ৯৯টি নাম প্রস্তাব আকারে জমা পড়েছে। সার্চ কমিটির কাছে জমা পড়া এসব নাম বাছাই করা হচ্ছে। আজ রোবাবারের মধ্যে বাছাই করে শর্টলিস্ট করা হতে পারে।


একই সঙ্গে তিনি বলেন, বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বৈঠকে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে যেসব মতামত দিয়েছেন সে বিষয়ে সার্চ কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।


এদিকে আজ রোববারও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে বসবে সার্চ কমিটি। বেলা চারটায় সুপ্রিম কোর্ট জাজেস লাউঞ্জে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।


বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল প্রথম দফায় অংশ নেওয়া প্রায় সবাই নাম প্রকাশের পক্ষেই কথা বলেছেন। কেউ কেউ অভিমত ব্যক্ত করেছেন, দলীয় সরকারের আমলে যারা সুবিধা পেয়েছেন এমন কেউ যাতে ইসিতে নিয়োগ না পান। নির্বাচন কমিশন এমনভাবে গঠন করতে হবে যাতে প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। সামরিক বাহিনী থেকেও একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সার্চ কমিটিকে বাছাইয়ের মাধ্যমে একটি ভালো কমিশন গঠন করতে হবে। সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সক্ষম এমন ব্যক্তিদের নিয়োগের সুপারিশ করতে হবে। দায়িত্ব পালনেও স্বাধীনচেতা হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বাস্তবায়নের সক্ষমতা থাকতে হবে। পাশাপাশি সবার কাছেই যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য হতে হবে। একই সঙ্গে কেউ কেউ থার্ড গ্রেড ব্যুরোক্রেসি দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন না করার সুপারিশ জানান। তবে আইনে ১০ জনের নামের তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশের জন্য বলা হলেও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ ১০ জনের বেশি তালিকা করার কথা বলেন।


বৈঠক শেষে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান বলেন, ইসি নিয়োগে সার্চ কমিটির ভ‚মিকা গুরুত্বপূর্ণ। এটা মাথায় রেখেই সার্চ কমিটিকে কাজ করতে হবে। দক্ষ, যোগ্য ও দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশন যোগ্য ও নিরপেক্ষ হলে তাদের অধীনে পরিচালিত নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। তিনি সার্চ কমিটিকে নামের তালিকা প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে বলেন, এতে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি স্থান পেলে সংশোধন করা সম্ভব হবে। সার্চ কমিটি সাংবিধানিক বডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। আস্থার বিষয়টি মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে।


প্রথম দফায় সকাল ১১টায় বৈঠক শুরু হয়। এতে অংশ নেন বিভিন্ন পেশার ১৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। প্রথম দফায় বৈঠক শেষে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, দলীয় সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী কোনো ব্যক্তি যেন ইসিতে স্থান না পান এমন দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি উপস্থিত আরো অনেকেই সমর্থন করেছেন। সুবিধাভোগী বলতে কী বুঝিয়েছেন' এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কেউ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন, এমন ব্যক্তি হতে পারেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং রাজনৈতিক দলের সুবিধাভোগী, এমন কাউকে যেন ইসি হিসেবে নিয়োগ না দেওয়া হয়, সেই প্রস্তাব করেছি। তবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি কেউ যাতে ইসি হিসেবে নিয়োগ না পান, তাও নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই প্রস্তাব করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী এবং এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি মাহফুজা খানম। তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিদের ইসিতে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছেন বলে জানান।


ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বৈঠক শেষে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যারা অবসরের পরও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ বা বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন, তারা যেন কোনোভাবেই ইসিতে না আসতে পারেন। আর যারা আসবেন, তাদের সুষ্ঠু নির্বাচন করার মানসিকতা ও সাহসিকতা যেন থাকে। ইসি গঠনের জন্য যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে, তাদের নাম যেন আগেই প্রকাশ করা হয়।


এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে বসা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির সঙ্গে বিএনপির আলোচনা করতে বা নাম জমা দিতে অসুবিধা কোথায়। বিএনপি সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন করছে। এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। তা তারা করতে পারে। কিন্তু ইসিতে ভালো লোক নিয়োগ না হলে সরকার পরিবর্তন করেও কোনো লাভ হবে না। নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন না হলে জাতির জন্য কঠিন হবে। একই সঙ্গে তিনি ইসিতে মাইনরিটি সম্প্রদায়ের একজনকেও নিয়োগের কথা বলেন।


আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকেই সার্চ কমিটির বাছাই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা উচিত।


৭১ টেলিভিশন চ্যানেলের সিইও মোজ্জাম্মেল বাবু বলেন, রাজনৈতিক বিভেদের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি করা মুশকিল। এজন্য সার্চ কমিটির উচিত হবে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে ইসিতে নিয়োগের সুপারিশ করা। তিনি নামের তালিকা প্রকাশের পাশাপাশি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেও একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করেন।


ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, আগামী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি ইসিতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব রাখা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিপন্থি কাউকে না রাখার সুপারিশও করেন।


সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ বলেন, যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন ছিল না, যোগ্য ব্যক্তি, তাদের নাম যেন প্রস্তাব করা হয়। যাদের নাম এসেছে তাদের সবার নাম প্রকাশ করার আহ্বান জানান। যাদের নাম প্রস্তাব করা হবে তাদের নামও যেন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।


যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, জনগণের বিশ্বাসের জায়গায় আছেন এমন ব্যক্তিদের নাম যেন প্রস্তাব করা হয়। নির্লোভ, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেন এমন ব্যক্তিদের নাম যেন প্রস্তাব করা হয়।


সার্চ কমিটির সঙ্গে দুই দফায় অংশ নেওয়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, ফিদা এম কামাল, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মুনসুরুল হক চৌধুরী, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, এম কে রহমান, শাহদীন মালিক, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহউপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মাহফুজা খানম, ব্রতীর নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ এবং ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) সভাপতি মুনিরা খান।


দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে ছিলেন এনটিভির বার্তা সম্পাদক জহুরুল আলম, জাগরণ পত্রিকার সম্পাদক আবেদ খান, প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, সমকাল প্রকাশক এ কে আজাদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, একাত্তরের সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, একুশে পদকপ্রাপ্ত সিনিয়র সাংবাদিক স্বদেশ রায় ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান।