কক্সবাজারের চকরিয়ায় পিকআপের চাপায় একই পরিবারের পাঁচ সহোদর মারা যান। এই নির্মম মৃত্যুর ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি নিহতদের পরিবারের।
পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গাড়িটি প্রথমে চাপা দিয়ে পুনরায় ব্যাক করে ফের চাপা দেয়। তাদের ধারণা, এতে করে হত্যা নিশ্চিত করে হত্যাকারী চালক।
এদিকে, গ্রেপ্তার চালক সাইফুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব বলছে, নিহতদের পরিবারের সঙ্গে চালকের কোনো পূর্বপরিচয় ছিল না। পরিবারের এমন অভিযোগের কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলে চালক সাইফুল র্যাবকে জানায়, ঘনকুয়াশা থাকায় তাদের আগে থেকে দেখতে পারেনি। পরে যখন দেখতে পেরেছে তখন ব্রেক কাজ করেনি। এই পরিবারের কাউকে সে আগে থেকে চিনত না।
ঘটনার পর পুনরায় ব্যাক করে চাপা দেওয়ার বিষয়ে চালক র ্যাবকে জানায়, ঘটনার পর সামনে প্রায় ১০০ গজ দূরে গাড়িটি থামায়। পরবর্তীতে চালক পিকআপ থেকে নেমে নিহতদের দেখতে এলেও মালিকের ছেলে তারেকের নির্দেশে সে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে। র্যাব বলছে, তবে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ এসেছে, পূর্বশত্রু তার যে অভিযোগ, সেটা তদন্তকারী কর্মকর্তা খতিয়ে দেখবেন।
চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত কক্সবাজারের চকরিয়ায় মৃত বাবার শ্রাদ্ধ শেষে ফেরার পথে বেপরোয়া গতিতে চলমান পিকআপের চাপায় পাঁচ সহোদরের নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ঘাতক পিকআপের চালক সহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান, র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, র্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১৫-এর অভিযানে গত ১১ ফেব্রæয়ারি রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে মর্মান্তিক ওই দুর্ঘটনায় জড়িত ঘাতক পিকআপ চালক সহিদুল ইসলাম ওরফে সাইফুলকে (২২) গ্রেপ্তার করে র্যাব। তার বাড়ি বান্দরবান। সে লামার আলী জাফরের ছেলে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ৮ ফেব্রæয়ারি ভোরবেলা কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট নামক স্থানে একটি পিকআপের চাপায় একই পরিবারের চার সহোদর অনুপম সুশীল (৪৬), নিরুপম সুশীল (৪০), দীপক সুশীল (৩৫) ও চম্পক সুশীল (৩০) ঘটনাস্থলেই মারা যান। পরবর্তীতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান অপর সহোদর ভাই স্মরণ সুশীল (২৪)।
ওই দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন তাদের সহোদর রক্তিম সুশীল এবং বোন হীরা সুশীল। বর্তমানে রক্তিম সুশীল চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন।
স্থানীয় সূত্রের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গত ৩০ জানুয়ারি নিহতদের পিতা সুরেশ চন্দ্র সুশীল বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। গত ৮ ফেব্রæয়ারি মঙ্গলবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অংশ হিসেবে পূজা শেষ করে তারা ৯ ভাই-বোন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মালুমঘাট বাজারের নিকট রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। এ সময় ভোর ৫টার দিকে কক্সবাজারমুখী বেপরোয়া গতিতে চলমান একটি পিকআপ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মূল সড়ক থেকে নেমে গিয়ে তাদের চাপা দেয় এবং ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে।
ওই ঘটনায় নিহতদের ভাই প্লাবন সুশীল (২২) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা পিকআপ চালককে আসামি করে কক্সবাজারের চকরিয়া থানায় সড়ক পরিবহণ আইনে মামলা করেন। যার নম্বর-১৫। এরই প্রেক্ষিতে, র্যাব দুর্ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত পিকআপের চালক সাইফুল নিহতদের গাড়ি চাপা দেওয়ার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করে। গ্রেপ্তারকৃতের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ঘাতক পিকআপের চাবি।
গ্রেপ্তারকৃত সাইফুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে জানায় যে, গত ৮ ফেব্রæয়ারি ভোরে আনুমানিক ৫ ঘটিকায় তারেক ও রবিউল নামক দুজনসহ চকরিয়া থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে সবজি বোঝাই পিকআপ নিয়ে সে রওনা করে। রাস্তায় অধিক কুয়াশা থাকা সত্তে¡ও চালক সাইফুল দ্রæত কক্সবাজার পৌঁছে সবজি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য বেপরোয়া গতিতে পিকআপটি চালাচ্ছিল। অধিক কুয়াশা ও অতিরিক্ত গতির কারণে মালুমঘাট বাজারের নার্সারি গেটের সামনে রাস্তা পার হওয়ার জন্য অপেক্ষারতদের চালক সাইফুল দূর থেকে লক্ষ করতে পারেনি। গাড়ির অধিক গতি থাকার কারণে কাছাকাছি এসে লক্ষ করলেও গাড়িটি সে নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে দুর্ঘটনাটি সংঘটিত করে। দুর্ঘটনার সময় তার সঙ্গে পিকআপ মালিকের ছেলে তারেক ও ভাগিনা রবিউল ছিল।
সে আরো জানায়, দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি প্রায় ৬৫-৭০ কি. মি./ঘণ্টা গতিতে চলছিল এবং চালক গাড়ি থামানোর জন্য ব্রেক করলেও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি প্রায় ১০০ ফুটের মতো সামনে চলে যায়। পরবর্তীতে চালক পিকআপ থেকে নেমে নিহতদের দেখতে এলেও মালিকের ছেলে তারেকের নির্দেশে সে দ্রæত ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারকৃত পিকআপ চালক সাইফুলের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও দীর্ঘ ২ বছর ধরে সে পিকআপ, চাঁন্দের গাড়ি ও ৩ টন ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালানোর কাজে নিয়োজিত ছিল। দুর্ঘটনার ১ সপ্তাহ আগে সে ওই পিকআপটি মালিকের নিকট থেকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে চালানো শুরু করে। ইতোপূর্বে সে বান্দরবানের লামাতে একটি রাবার বাগানে চাকরি করত বলে জানা যায়।
তিনি বলেন, দুর্ঘটনা-পরবর্তী গ্রেপ্তারকৃত সাইফুল মালুমঘাট বাজারের একটি স্থানে গাড়িটি থামিয়ে মালিককে ফোন করে দুর্ঘটনার বিষয়টি জানায়। গাড়িটির মালিক তাকে পিকআপটি পরবর্তী কোনো এক স্টপেজে রেখে লোকাল বাসে করে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। মালিকের নির্দেশনা অনুযায়ী, গ্রেপ্তারকৃত সাইফুল ডুলাহাজারায় এসে পিকআপটি রাখে এবং লোকাল বাসে করে চকরিয়া গিয়ে মালিকের সঙ্গে দেখা করে। পিকআপের মালিক মাহমুদুল তাকে ন্যূনতম ১ বছর আত্মগোপনে থাকার পরামর্শ দিলে সে প্রথমে তার পূর্ববর্তী চাকরিস্থল বান্দরবানের লামার রাবার বাগানে আত্মগোপনে যায়। পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে অন্যত্র আত্মগোপনের উদ্দেশে ঢাকায় আসে এবং রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়।
পিকআপের মালিক মাহমুদুল করিম মূলত সবজি পরিবহণের ব্যবসা করেন। তিনি চকরিয়ার সবজির আড়ত থেকে কক্সবাজার সদর ও মহেশখালী এলাকায় সবজি সরবরাহ করতেন। তার ছেলে তারেক সবজি সরবরাহের তদারকি করত এবং ভাগিনা রবিউল তারেকের সহযোগী হিসেবে কাজ করত। তিনি ২০১৬ সালে ওই পিকআপটি ক্রয় করেন। মূলত সবজি পরিবহণের উদ্দেশেই পিকআপটি ব্যবহার করা হতো। গত ৪ বছর ধরে ওই পিকআপের ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেন এবং গত তিন বছর ধরে রুট পারমিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। দুর্ঘটনা-পরবর্তী পিকআপের মালিক, তার ছেলে তারেক ও ভাগিনা রবিউল আত্মগোপনে রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।