logo
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:১৬
ভাষাসৈনিকের রিকশাচালক ছেলে খুলেছেন ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র
এইচ এম লাহেল মাহমুদ, পিরোজপুর

ভাষাসৈনিকের রিকশাচালক ছেলে খুলেছেন ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র

তার বাবা ছিলেন ভাষাসৈনিক। তবে তেমন কিছু রেখে যাননি। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য জমিতেই থাকেন তিনি। রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। অভাবের সংসারে এক বেলার আহার জোটাতেই কষ্ট হয় তার। এর মধ্যে আবার স্বামী পরিত্যক্তা বোনকেও দেখাশোনা করেন। তবে বাবাকে স্মরণ করে গর্ব করেন তিনি। বাবার দেখানো আদর্শে বাড়ির সামনেই খুলেছেন বাংলা ভাষা শিক্ষার একটি কেন্দ্র। যেখানে বিনামূল্যে শিশুদের বাংলা ভাষার ইতিহাস জানানো হয়। শেখানো হয় ভাষাও। বলছি, পিরোজপুর শহরের মুচিপাড়ার বাসিন্দা ভাষাসৈনিক মো. জালাল উদ্দিনের ছেলে হেলাল উদ্দিনের কথা।


বাংলা ভাষা শিক্ষার ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি কাঠের তৈরি কক্ষে সারি সারি করে রঙ-বেরঙে বাংলা ভাষার বিভিন্ন বর্র্ণ সাজানো হয়েছে। রয়েছে কয়েকজন খুদে শিক্ষার্থীও। তাদের সেখানে পড়ানো হচ্ছে। যার জন্য দিতে হয় না কোনো পারিশ্রমিক।


হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘করোনার জন্য স্কুল বন্ধ। স্থানীয় গরিব শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেতে পারছে না। তারা কিছু শিখতেও পারছে না। অর্থাভাবে তারা প্রাইভেটও পড়তে পারে না। তাদের লেখা-পড়া বন্ধ। তাদের জন্য শিক্ষাকেন্দ্রটি খোলা। আমার খাইতে কষ্ট হইলে হবে কি? বাবা বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে তার চাকরি হারিয়েছে, জেল খেটেছে। আর আমি এই এলাকার অসহায় পোলাপানের বাংলা ভাষা শেখার জন্য একটা কিছু করব না তা কেমনে হয়। এ জন্যই বাসার সামনে এই কেন্দ্রডা খোলা।’


নিজের বাবার কথা জানিয়ে হেলাল বলেন, ‘বাবা ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তার স্বীকৃতি মেলেনি। ২০০৯ সালে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি না পাওয়ায় তার আক্ষেপ ছিল।’


এক ছেলে ও তিন মেয়ে রেখেই মারা যান ভাষাসৈনিক মো. জালাল উদ্দিন। ছেলে হেলাল রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এক মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা। আরেক মেয়ের জামাইও রিকশা চালান।


ভাষাসৈনিক মো. জালাল উদ্দিনের রেখে যাওয়া পিরোজপুর শহরের মুচিপাড়ার ওই জমিতে হেলাল থাকেন। পাশেই দুই বোন ডলি ও পলির বাস। এদের মধ্যে স্বামী পরিত্যক্তা প্রতিবন্ধী বোন পলি একটি ভাঙাচোরা ঘরে বাস করেন। সে ঘরে নেই চালা। চালার প্রতিটি টিন ভেঙে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সামনেই আরেক মেয়ে তানিয়া সুলতানা পলির কাঠ আর টিন দিয়ে তৈরি ঘর।


হেলাল উদ্দিন জানান, তার ব্যাটারিচালিত ওই রিকশাটির ব্যাটারি ভালো নেই। ব্যাটারি কেনার জন্য তার কাছে কোনো টাকাও নেই। রিকশা চালিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ জোগাতে হয় তার। দেখাশোনা করতে হয় অসুস্থ বোনকেও।


তিনি বলেন, ‘আগে থাকার জন্য আমাদের কোনো ঘর ছিল না। বছরখানেক আগে স্থানীয় এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম আমার অসহায়ত্বের কথা শুনে একটি ঘর করে দেন। সেখানেই স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোনোমতে বাস করছি। ছোট বোন পলির ঘরটি ভাঙাচোরা। এই শীতে ওই ঘরে বাস করার মতো অবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে ভিজে যায়। অনেক সময় বোনের না খেয়েও দিন কাটাতে হয়। আমি রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে বোন পলিকে সামান্য সহযোগিতা করি।’


হেলাল উদ্দিনের মেজো বোন ডলি জানান, তার স্বামী পেশায় একজন রিকশাচালক। এক কন্যা প্রতিবন্ধী, আর স্বামীও প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে স্বামীর গ্রামের বাড়ির জমি বিক্রি করে একটি কাঠের ঘর তৈরি করেছি। সেখানে সন্তানদের নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এ পর্যন্ত সরকারি কোনো সাহায্য পাননি।


ভাষাসৈনিক জালাল উদ্দিনের পরিবার সম্পর্কে স্থানীয় নারী নেত্রী শিরিন আফরোজ বলেন, ‘প্রায় দুই বছর আগে আমি ভাষাসৈনিক জালাল উদ্দিনের ছেলের রিকশায় করে শহর থেকে বাসায় ফিরছিলাম। তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয়। তার বসবাস করার জন্য কোনো ঘর ছিল না। আমি বিষয়টি স্থানীয় এমপি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে জানালে তিনি একটি পাকা ঘরের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ঘরেই তিনি এখন বসবাস করছেন।


জালাল উদ্দিনের পরিবারের বিষয় নিয়ে পিরোজপুরের সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বশির উদ্দিনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘ভাষাসৈনিকের একমাত্র ছেলের সমস্যার কথা শুনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর নির্দেশে তাকে বসবাসের জন্য একটি ঘর দেওয়া হয়েছে। অন্যদের সমস্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’