শীতের শেষে ফুটলো শিমূল, মন দোলালো উতাল মাতাল হাওয়া। আজকে মনে বাজছে তোমার গান, এই ফাগুনে এটাই পরম পাওয়া। ফাল্গুন মানে বসন্ত আবাহন। শীতের বিদায় প্রকৃতিতে, পাতা ঝরা গাছে ফুটছে নতুন কুঁড়ি, গাছে গাছে নতুন রঙিন ফুল। নতুন গানে প্রকৃতির এই পালাবদলকে আমন্ত্রণ করছে যেন পাখির দল। মন খুলে আজ বলা যায়, বসন্ত এসে গেছে। শুভ বসন্ত আজ জাগ্রত দ্বারে।
আজ বসন্তের শুরু। করোনাকালের কষ্ট যতই থাকুক, নিয়ম করে যেন আগের মতই সেজেছে ঋতুরাজ। দখিনা হাওয়া, মৌমাছিদের গুঞ্জরণ, কচি-কিশলয় আর কোকিলের কুহুতানে জেগে ওঠার দিন আজ। গীতিকবির ভাষায় এই বসন্তে না গেয়ে গান থাকতে পারি কী।
লাল আর বাসন্তী রঙে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সাজিয়ে আজ বসন্তের উচ্ছ্বলতা ও উন্মাদনায় ভাসবে বাঙালি। বসন্ত অনেক ফুলের বাহারে সজ্জিত হলেও গাঁদা ফুলের রংকেই এদিনে তাদের পোশাকে ধারণ করে তরুণ-তরুণীরা। খোঁপায় শোভা পায় গাঁদা ফুলের মালা। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যাবে না গ্রামীণ জীবনও। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান, নৃত্য আর চিত্রকলায়।
সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শনেও বসন্ত ঠাঁই করে নিয়েছে তার আপন মহিমায়। বসন্ত ঋতু লুকিয়ে আছে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসের ভিতর। বসন্তের প্রথম মাসটি বাঙালিদের জন্য বড় আবেগের, বড্ড ভালোবাসার। এই মাসেই আমরা নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার পাই।
মাসটি আবার বাঙালির জন্য বেদনারও। কারণ এই মাসে বাংলা ভাষার দাবিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত শফিকরা। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন ঘটেছিল মহান ভাষা আন্দোলন। যা আজ বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারির মোড়কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এর আগে পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। এরশাদ সরকারের সময় এই পরিবর্তনটি করা হয়েছিল মাসগুলোর মধ্যে একটি শৃঙ্খলা আনার জন্য। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল ৮ ফাল্গুন। সেই তারিখটি হারিয়ে ফেলি আমরা। এই দিবসটির ঐতিহ্য ফেরাতে দুবছর আগে সরকার আবারও বাংলা মাসে পরিবর্তন আনে। এরফলে এখন ফাল্গুনের শুরুটা হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফলে এই তারিখটি একইসঙ্গে ভ্যালেন্টাইন দিবসও।
শুধু আমাদের দেশে নয়, ঋতু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এই বসন্ত ঋতু তথা ফাল্গুন মাসে দক্ষিণ এশীয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের পাশাপাশি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানেই এ সময়টি আশীর্বাদ রূপে আসে। এ সময়টা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মৃদু মানের বর্ষা হয় যার ফলে সেসব স্থানে বৃক্ষরা পত্রপল্লবে নিজেদের জানান দেয়। অন্যদিকে হীমাচল প্রদেশসহ কাস্মীর অঞ্চলের তুষারপাত ক্রমে কমে আসে এবং মানুষ তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মের ভরসা পেতে থাকে।
প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় আয়োজন করা হয় বসন্ত উৎসব। এদিন চারুকলা থেকে শুরু হয়ে এ উৎসব ছড়িয়ে পড়ে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চ, লক্ষ্মীবাজারের বাহাদুর শাহ্ পার্ক এবং উত্তরার ৩ নং সেক্টরের রবীন্দ্র সরণির উন্মুক্ত মঞ্চে। এ ছাড়া বিভিন্নস্থানে বসন্ত বরণের আয়োজন করা হয়।
গত বসন্ত ছিল এদেশের মানুষের অস্থিরতার সময়। করোনার ছোবলে থমকে গিয়েছিল সবকিছু। বসন্ত মানেই যেখানে নতুন প্রাণের কলরব, সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেকটায় ম্লান করে দিয়েছিল। এবারো পরিস্থিতি পুরাপুরি অনুকুলে না আসলেও অন্যরকম বসন্ত উদযাপনের অপেক্ষায় আছে বাঙালি মন। এ দিনে বর্ণিল পোশাক আর ফুলের বর্ণচ্ছটা গায়ে মাখিয়ে তরুণ-তরুণীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, চারুকলার বকুলতলাসহ সারা দেশ মাতিয়ে রাখবে।