‘ছাত্রদের ১৪৪ ধারা অমান্যের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বহু কথিত ও বহু লিখিত একটি বিতর্কিত বক্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হয়। সে উপলক্ষে প্রথমেই বলা দরকার যে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নটি ছিল যেমন তাৎপর্যপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্যই এই দিকে কেউ কেউ অসঙ্গত কৃতিত্বের দাবি করে আসছেন এবং তাদের কারো কারো লেখায় এমন দাবি বরাবর নানা সূত্রে প্রতিফলিত হয়ে আসছে যে ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে এগারো জনের একটি গ্রুপ ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে পরদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার মতো একটি বৈপ্লবিক কাজ সম্ভব হয়েছে; কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঘটনাদি এমন ভিত্তিহীন দাবি সমর্থন করে না।’
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বইতে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগ মুহূর্তের ঘটনাবলি।
বইতে আরো লেখা হয়েছে, ...যতটুকু জানা যায় ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারির পরপরই হল-হোস্টেলের জঙ্গি ছাত্রগ্রুপ এই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চিন্তায় সরব হয়েছে। তাদের সমর্থনে ছিল রাজনীতিসচেতন ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। ঐ অবস্থায় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ এবং সাংবিধানিক রাজনীতিকদের দ্বারা প্রভাবিত সর্বদলীয় বৈঠকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ, যুবলীগ, মেডিকেল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং কয়েকটি হলের ছাত্রকর্মীগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করে কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তে দৃঢ় প্রত্যয় প্রকাশ করেন। এদের মধ্যে সে রাতেই এ বিষয়ে যোগাযোগও ঘটেছে ঐ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য, যেমন মেডিকেল কলেজ থেকে ঢাকা হল, জগন্নাথ কলেজ থেকে মেডিকেল কলেজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে’।
আহমদ রফিক লিখেছেন, ‘কাজেই এ বিষয়ে এককভাবে কয়েকজনের সিদ্ধান্ত আলাদাভাবে কোন ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে না এইজন্য যে এই সিদ্ধান্ত অন্যান্য জঙ্গি ছাত্রগ্রুপের সামগ্রিক সিদ্ধান্তেরই অংশ মাত্র, একক ও অনন্য কৃতিত্বের প্রকাশ নয়। কিন্তু এদের সংঘবদ্ধ ও সুপরিকল্পিত প্রচারের কারণে এ সম্পর্কে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়েছেন, এমনকি হয়েছেন ভাষা আন্দোলনের জনৈক ইতিহাস লেখকও।
বিষয়টিকে যথাযথ ঘটনাদির আলোকে বিশ্লেষণ এবং সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার না করার কারণে ঐ লেখক এক বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন এই বলে যে, ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত করেন তিনটি পক্ষ : ছাত্ররা, যুবলীগের নেতা ও কর্মীগণ এবং ছাত্রনেতাদের কয়েকজন পৃথকভাবে। ১০৩ এখানে শেষোক্ত পক্ষ বলতে লেখক গভীর রাতে পুকুরপাড়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ছাত্রদের বোঝাতে চেয়েছেন।
কিন্তু এ ধরনের ‘পক্ষ’ ভাগ একেবারেই অসঙ্গত। এবং তা একাধিক প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেমন, প্রথম পক্ষ হিসেবে ছাত্রদের কথা বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন? তারা কি পুকুরপাড়ে বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রদের থেকে পৃথক?
বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন সে ক্ষেত্রে কোন্ পক্ষ? এমনকি মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের জঙ্গি ছাত্রগ্রুপের ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারাই-বা এদিক থেকে ‘পক্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত ও বিবেচিত হবেন না কেন? আন্দোলনে বা ১৪৪ ধারা অমান্য করার আয়োজনে এই দুই কলেজের সক্রিয় ছাত্রগ্রুপের ভূমিকা কোন অংশেই কম ছিল না।
আসলে এভাবে ‘পক্ষ’ বিভাগের সীমারেখা টানা যেমন হাস্যকর তেমনি অসঙ্গতও বটে। অন্যদিকে তথাকথিত তৃতীয় পক্ষের আত্মপ্রচারণামূলক বিবরণে পরিস্ফুট কিছু কিছু তথ্যগত ভুলত্রুটি তথা অসঙ্গতিও ইতিহাস লেখকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। যেমন পুকুরপাড়ে গভীর রাতের বৈঠকে উপস্থিত ছাত্রদের নাম তালিকা। বিভিন্ন সময়ে একই ব্যক্তির, যেমন এম. আর. আখতার মুকুলের লেখায় নতুন নাম যুক্ত হতে বা পূর্বে উল্লিখিত কারো নাম বাদ পড়তে দেখা গেছে। আবার বৈঠকের সময় এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের সংখ্যা নিয়েও বিভিন্নতা দেখা গেছে।
যেমন কথিত বৈঠকে উপস্থিত হাবীবুর রহমান শেলীর বক্তব্যের সাথে এম. আর. আখতার মুকুল এবং গাজীউল হকের বক্তব্যের বৈসাদৃশ্য যথেষ্ট, যদিও এরা একই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন...’।