logo
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:২০
চাপ কাটিয়ে উচ্ছ্বাস
উচ্চশিক্ষার যুদ্ধে ১৩ লাখ ৬ হাজার শিক্ষার্থী
নিজস্ব প্রতিবেদক

চাপ কাটিয়ে উচ্ছ্বাস

এইচএসসির ফল প্রকাশের পর রোববার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে উচ্ছ্বাস শিক্ষার্থীদের। ছবি ভোরের আকাশ

অবশেষে মিলেছে প্রতীক্ষিত ফল। করোনাকালে দীর্ঘ দুবছরেরও বেশি সময় মানসিক চাপ ও আতঙ্কের মধ্যে কাটানোর পর ফল পেয়ে উচ্ছ্বসিত এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। করোনা মহামারির কারণে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাস করেছেন ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলে গড় পাসের এ হার। দীর্ঘ অপেক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে যাওয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন, যা উত্তীর্ণের মোট সংখ্যার ১৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এইচএসসির গÐি পার হওয়ার পর এবার পাস করা সব শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছেন।


গতকাল রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০২১ সালের উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করেন। পরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে এবারের ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। এরপর পরীক্ষা কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও অনেকে ফল সংগ্রহ করেন। তবে মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ফল সংগ্রহ করেছেন।


করোনার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ফলাফল আনতে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাননি। ফলে রাজধানীর নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অন্য বারের মতো এবার খুব একটা ভিড় চোখে পড়েনি। ছিল না চোখে পড়ার মতো উৎসবের আমেজও। ফল পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর পারিবারিকভাবেই আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন অনেকেই। দুপুর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলাফল নিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু হয়। কেউ নিজের ফল নিজেই জানান। বাবা কিংবা পরিবারের লোকজন সন্তানদের সাফল্য জানিয়ে স্ট্যাটাস দেন। একে একে ফেসবুকের পাতা ভাসতে থাকে ফলপ্রাপ্তির খবর আর অভিনন্দনের জোয়ারে।


মহামারির কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমানের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাননি। পরে জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে তাদের মূল্যায়ন ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭৭ জন শিক্ষার্থীর সবাই পাস করেন, জিপিএ-৫ পান এক লাখ ৬১ হাজার ৮০৭ জন।


আগের বারের চেয়ে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ২৭ হাজার ৩৬২ জন। মহামারি শুরুর আগে ২০১৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় সার্বিকভাবে পাস করে ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে মোট ৪৭ হাজার ২৮৬ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। আর ২০১৮ সালে পাসের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ২৯ হাজার ২৬২ জন।


২০২০ সালে মহামারির প্রকোপে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। ২০২১ সালে পরীক্ষা ছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পরের ধাপে পাঠাতে চায়নি সরকার। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের অপেক্ষায় আট মাস পিছিয়ে যায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। স্বাভাবিক সময়ে এপ্রিলে এ পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে তা শুরু হয় গত বছরের ২ ডিসেম্বর।


বাংলা ও ইংরেজির মতো আবশ্যিক বিষয়গুলোর পরীক্ষা এবার নেওয়া হয়নি। তার বদলে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে সেসব বিষয়ের মূল্যায়ন করে পূর্ণাঙ্গ ফলাফল তৈরি করা হয়েছে।
ফল প্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা সেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য ও উজ্জ¦ল ভবিষ্যৎ কামনা করেন।


শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি অনুষ্ঠানে বলেন, কারিগরি শিক্ষার বিষয়ে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখব, তারা কারিগরি শিক্ষা ও গবেষণায় জোর দিয়েছে। শিক্ষার সকল পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে বলে জানান তিনি।


শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করে সনদ পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে অনার্স পর্যায়ে শর্ট কোর্সের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।


কোন বোর্ডে কত পাস
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৯৬ দশমিক ২০। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৯ হাজার ২৯৯ জন শিক্ষার্থী। রাজশাহী বোর্ডের পাসের হার ৯৭ দশমিক ২৯; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩২ হাজার ৮০০ শিক্ষার্থী। যশোর বোর্ডের পাসের হার ৯৮ দশমিক ১১; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২০ হাজার ৮৭৮ জন শিক্ষার্থী। দিনাজপুর বোর্ডের পাসের হার ৯২ দশমিক ৪৩; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৫ হাজার ৩৪৯ জন শিক্ষার্থী।


কুমিল্লা বোর্ডের পাসের হার ৯৭ দশমিক ৪৯; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৪ হাজার ১৫৩ জন শিক্ষার্থী। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৮৯ দশমিক ৩৯; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৩ হাজার ৭২০ জন শিক্ষার্থী। সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৯৪ দশমিক ৮০; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৭৩১ জন শিক্ষার্থী।


বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৭৬; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯ হাজার ৯৭১ জন শিক্ষার্থী। ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৭১; জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ হাজার ৬৮৭ জন শিক্ষার্থী।


এবার ১১টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নয় হাজার ১১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭১৮ জন পাস করেছেন। সার্বিক পাসের হার ৯৫ দশমিক ২৬। নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন। মাদ্রাসা বোর্ডে পাসের হার ৯৫ দশমিক ৪৯, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৮৭২ জন। কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৯২ দশমিক ৮৫, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫ হাজার ৭৭৫ জন।


পাসে যশোর, জিপিএ-৫-এ শীর্ষে ঢাকা
উচ্চমাধ্যমিকের ফলে এবার পাসের হারে শীর্ষে রয়েছে যশোর বোর্ড। প্রতিবারের মতো সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে ঢাকা বোর্ডে।


এবারের ফলাফলে দেখা গেছে, যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১১ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম পাস করেছে চট্টগ্রাম বোর্ডে। এ বোর্ডে ৮৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। ঢাকা বোর্ডে পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পেয়েছেন ৫৯ হাজার ২৩৩ জন শিক্ষার্থী। আর সিলেট বোর্ডে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪ হাজার ৭৩১ জন, যা নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে কম। ঢাকা বোর্ডের উত্তীর্ণদের মধ্যে ১৯ দশমিক ১০ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন, আর সিলেট বোর্ডে পেয়েছেন ৭ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী।


জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৮৯ হাজার
এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন, জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এইচএসসিতে এবার ১১ লাখ ১৫ হাজার ৭০৫ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন; তাদের মধ্যে ১০ লাখ ৬৬ হাজার ২৪২ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। সাধারণ বোর্ডগুলোর পাসের হার ৯৫ দশমিক ৫৭, জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক লাখ ৭৮ হাজার ৫২২ জন।


মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ৯৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৯২ দশমিক ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে ৪ হাজার ৮৭২ জন এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ৫ হাজার ৭৭৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছেন।


দেশের বাইরে আট কেন্দ্র
এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় এবার দেশের বাইরের আটটি কেন্দ্রে ৯৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। বিদেশের আটটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ২৬৭ জনের মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন ২৬৪ জন, জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ জন।


মহামারির মধ্যে গত বছর পরীক্ষা হয়নি, মূল্যায়ন ফলে শতভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছিল। বিদেশের কেন্দ্রগুলোতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৬২ জন। সেই হিসাবে এবার বিদেশের কেন্দ্রে পাসের হার কমেছে ১ দশমিক ১২ শতাংশ, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থী বেড়েছে ৩০ জন।


পাঁচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবাই ফেল
চলতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় সারা দেশের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সব পরীক্ষার্থী ফেল করেছেন। করোনার কারণে ২০২০ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ফলে কোনো শূন্যপাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। আর শতভাগ পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৬৩টি। সেই তুলনায় ২০২১ সালে শতভাগ পাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমেছে ৭ হাজার ১২৯টি।


এবারের শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সবগুলোই সাধারণ শিক্ষাবোর্ডের। মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ডে শূন্যপাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। শূন্যপাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম বোর্ডে দুটি, দিনাজপুর বোর্ডে দুটি ও ময়মনসিংহ বোর্ডে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এবার মোট ৯ হাজার ১১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিয়েছিলেন।

পুনর্নিরীক্ষার আবেদন আজ থেকে
প্রকাশিত ফলাফলে যেসব শিক্ষার্থী অসন্তুষ্ট হবেন, তারা ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের সুযোগ পাবেন। আজ সোমবার থেকে ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন গ্রহণ শুরু হবে। ২০ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ফল পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করা যাবে। গতকাল রোববার আন্তঃশিক্ষাবোর্ড থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।