logo
আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১১:৪৮
ভোরের আকাশের অনুসন্ধান
জিন-পরীরাও টাকা ছাড়া কাজ করতে সমস্যায় পড়ে!
ইদ্রিস আলম

জিন-পরীরাও টাকা ছাড়া কাজ করতে সমস্যায় পড়ে!

প্রেমিকাকে ফিরে পেতে, অনৈতিক কাজের মনোবাসনা পূরণ করতে কোনো চিন্তা নেই! এজন্য আছেন কথিত তান্ত্রিক গুরু। টাকা দিলেই শতভাগ মনোবাসনা পূরণ সম্ভব। তবে আগ্রহ বা বেশি দুর্বলতা দেখালে গুরুর দামও বাড়ে। সেইসঙ্গে বেড়ে যায় টাকার পরিমাণও। হ্যাঁ, সত্যি বলছি। শতভাগ সফলতার নিশ্চয়তা দিয়েই কথিত তান্ত্রিক গুরুরা সবরকমের মনোবাসনা পূরণের আশ্বাস দেন। মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবে সক্রিয় এরকম বহু প্রতারক চক্র।


ভোরের আকাশের অনুসন্ধানে এমন একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে। সরল বিশ^াস নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে চলে আলোচনা। তবে চতুর এ চক্র নানা কায়দায় টাকা নেওয়ার কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। হাল ছাড়েননি অনুসন্ধানী প্রতিবেদকও। তান্ত্রিক যত রকম কৌলশের আশ্রয় নেন, প্রতিবেদকও তাকে ধরতে ও তার প্রতারণার সবকিছু পাঠকের কাছে তুলে ধরতে অনুসন্ধানের জাল আরো বিস্তার করতে থাকেন। সঙ্গে নেন একাধিক অনুসন্ধানী সাংবাদিককেও। সবাই মিলে তান্ত্রিকের থলের বিড়াল বের করার চেষ্টায় দিনভর চলে অভিযান। একপর্যায়ে প্রতারকের সবরকমের অপকর্ম ও টাকা নেওয়ার কৌশল প্রকাশ হলেও শেষ পর্যন্ত সে টাকা না পেয়েই পিছু হটে। এর মধ্যে সঞ্চয় হিসাবে থেকে যায় প্রতারক চক্রের সব অপকৌশল। যার ভিডিও ও ভয়েস রেকর্ড রয়েছে ভোরের আকাশের হাতে।


ইউটিউব থেকে ফোন নম্বর নিয়ে তান্ত্রিক গুরুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন একজন চাকরিজীবী। যার ছদ্মনাম কায়েস আহমেদ। এক রাতের জন্য প্রেমিকাকে তার কাছে এনে দিতে হবে। বিনিময়ে গুনতে হবে ২০ হাজার টাকা। এমন চুক্তির পর গুরু পাঠালেন একটি বাংলালিংক পার্সোনাল বিকাশ নম্বর। তান্ত্রিক গুরু প্রতিশ্রæতি দেন টাকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে কাজ। এজন্য দিতে হবে ছেলেমেয়ের ছবি আর নামের তালিকা। এরকম একজন ব্যক্তি তান্ত্রিক গুরুর কাছে প্রতারিত হওয়ার পর তার খবরে ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে তান্ত্রিক গুরুর সঙ্গে সমস্যার কথা বলে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়।


প্রতারণার বিস্তার যেভাবে : কায়েস জানান, প্রথমে তান্ত্রিক গুরুর সঙ্গে পরিচয়ের পর সমস্যা সমাধানে ২০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। প্রথম ধাপে পাঠানো হয় ৫ হাজার টাকা। এতে কিছুটা নাখোশ হন সব সমস্যা সমাধানের মহাক্ষমতার অধিকারী তান্ত্রিক। এরপর গুরুজি ইমুতে ফোন করে জানান, তিনি এমন একটি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, যা আগে কখনো তাকে হতে হয়নি। সমস্যার কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘বাড়ি ও মেয়ের শরীর বান মেরে বন্ধ করা আছে। আরো টাকা দিতে হবে।


ফের পাঠানো হলো টাকা। দ্বিতীয় দফায় টাকা পাঠানোর পর কৌশল পাল্টায় এ প্রতারক। অন্য অজুহাত নিয়ে এসে হাজির হয়। তিনি বলেন, ‘বিরাট সমস্যা দেখা দিয়েছে ভাই। এবার জিন কাজ করবে না। এজন্য হিন্দুদের মন্দিরে প্রসাদ দিতে হবে। সমস্যা সমাধানে মন্দিরে ছাগল কিনে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। তাই আরো কিছু টাকা পাঠান দ্রæত। প্লিজ দেরি হলে কাজ হবে না’। প্রতারণার শিকার হওয়া কায়েস জানান, একপর্যায়ে ভিডিও কলে তান্ত্রিকের সঙ্গে আমার কথা হয়। এ প্রতারক চক্রে রয়েছে একাধিক সদস্য। তারা নিজেদের কণ্ঠ এমন করে কথা বলেন, পাশে ভয়ংকর শব্দ শোনা যায়। কথা বলে আস্তে আস্তে, ভরাট কণ্ঠে।


একপর্যায়ে ভিডিও কলে অপর প্রান্তে দেখা যায়, তান্ত্রিক গুরু একটি সাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে ঢাকা, অদৃশ্য চেহারা। পাশে শোনা যায় ভয়ংকর শব্দ। বলা হয়; জিনরা কথা বলছেন ভয় পাবেন না। রুমের ভেতরে দেখা যায় মানুষের মাথাওয়ালা কঙ্কাল। হাতের অংশ বিশেষ আরো অনেক কিছু। ফোনে সরাসরি কথা বলেন না তিনি। এ তথ্য জানার পর, এবার নাম-পরিচয় গোপন রেখে এমন কি ইমু থেকে প্রতিবেদকের ছবিটিও পরিবর্তন করে ত্রান্ত্রিক গুরুর কাছে ভোরের আকাশ থেকে ফোন।


সালাম দিয়ে সমস্যার কথা লিখে পাঠানো হলো একটু খুদেবার্তা। সঙ্গে সঙ্গে ফিরতি এসএমএস আসে। সেখানে লেখা ছিল, ‘আপনার জন্য কি সেবা করতে পারি’। তাকে জানানো হয়, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে তাকে যেকোনো মূল্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। জবাবে তান্ত্রিক বলেন, কোনো সমস্যা নেই কাজ হবে শতভাগ। এজন্য ছেলেমেয়ের নাম আর ছবি পাঠান। কিন্তু তার আগে কাজের জিনিসপত্র কিনতে লাগবে ৭ হাজার ১০০ টাকা। দেওয়া হয় পূর্বের ভুক্তভোগীদের দেওয়া সেই বিকাশ নম্বর। কাজের নিশ্চয়তায় বলা হয়, ১২ ঘণ্টার মধ্যে প্রেমিকা চলে আসবে।


এখানেই শেষ নয়। প্রতিবেদক টাকা পাঠানোর জন্য সময় নেয় ৩০ মিনিট। এর মধ্যে গুরু ইমুতে এসএমএস পাঠান বেশ কয়েকবার। কারণ তিনি দিনে কথা বলেন না, রাতে ইমুই তার কথা বলার একমাত্র ভরসা। টাকা পাঠানোর সময় গরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে বাজারে জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে বসে আছেন গুরু। এ ঘটনা গতকাল রোববার ঘড়ির কাঁটায় তখন ৩টা ৪৫ মিনিট। বিরক্ত হয়ে হঠাৎ রাতের সাম্রাজ্যের তান্ত্রিক গুরু ওরফে জিনের বাদশাহ ফিরে এলেন দিনের বেলায় ইমুতে। একী কাÐ গুরু তো দিনে কথা বলেন না।


টাকা না পেয়ে আর যেন তর সইছে তা গুরুজির। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তান্তিক গুরু বলছেন, ‘ভাই, আপনি তো কথা দিয়ে কথা রাখলেন না। বিকাশে তো ৭ হাজার ১০০ টাকা পাঠালেন না। আর কত সময় লাগবে বলেন তো। আমি তো বাজারে বসে আছি। টাকা পাঠালে জিনের জন্য জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাব। ১২ ঘণ্টার মধ্য কাজ করে দেব। আমাকে তো বিশ্বাস করেন? ফের বিকাশে টাকা পাঠাতে গুরুর কাছে সময় চাওয়া হয় ২৫-৩০ মিনিট।
মাঝে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য প্রতিবেদকের ইমুতে একের পর এক এসএমএস পাঠাচ্ছেন গুরু। নির্দিষ্ট সময় শেষে নিয়ম ভেঙে আবারো তান্ত্রিক গুরুর ইমুতে ফোন! তখন ঘড়ির কাঁটায় ৪টা ১০ মিনিট। অপর প্রান্ত থেকে ত্রান্তিক গুরু বলছেন, ‘আপনি কথা দিয়ে রাখছেন না। আসলে আমাকে বলেন তো ভাই, কত সময় লাগবে। আমি তো বাজারে বসে থেকে থেকে বাড়িতে চলে আসলাম’। প্রতিবেদক বলেন, হুজুর আমাকে আর মাত্র ২৫ মিনিট সময় দেন। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য মাফ করবেন আমাকে।


গুরুজি বলেন, ‘গুরু আরে না কোনো সমস্যা নেই। আমি কষ্ট করে আবার যাচ্ছি বাজারে।’ বাজার কোথায় এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর। টাকা পাঠান, কোনো সমস্যা নেই; কাজ ১০০ ভাগ হবে। আমি অনেক মেয়েকে ফিরেয়ে দিয়েছি। শুধু দেখেন আমি কী করি। এরপর কৌশলে প্রতিবেদক জানতে চানÑ কাজের পদ্ধতি কী, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি, কুফরি করে আনা যাবে না? জবাবে গুরু বলেন, ‘বিভিন্ন পদ্ধতিতে কাজ হয়। সরাসরি জিন নিজে কাজ করে। আমাকে বিশ্বাস করেছেন তো। ১২ ঘণ্টা ও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কাজ হয়। আপনারটা ১২ ঘণ্টার মধ্যে এনে দেব। কাজ শেষে দেখবেন আপনাকে ছাড়া সে আর কিছু বুঝবে না।’


তান্ত্রিকের প্রতারণা ধরতে ইতোমধ্যে প্রতিবেদকের সঙ্গে যুক্ত হন আরো কয়েকজন সাংবাদিক। তারপর গুরুজির কাছে জানতে চাওয়া হয়Ñ কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে। বলা হয়, একটু যদি প্রদ্ধতি বলতেন, তাহলে সাহস পেতাম। আপনি ছাড়া দুনিয়ায় আমার কেউ নেই এখন? গুরু বলেন, ‘আমি বলেছি তো, আপনি শুধু টাকা পাঠান। আমি আপনার জন্য কী করি দেখেন। একটু বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বাজারে ভাই এসব কথা তো মানুষের সামনে বলা যায় না। বাড়িতে গিয়ে আমি সব প্রদ্ধতি বলে দিচ্ছি, টাকা পাঠান’। টাকা দেওয়ার দেনদরবারে একপর্যায়ে পিছু হটেন তান্ত্রিক।


প্রতারণার শিকার সোহেল রানা নামে এক ভুক্তভোগী ভোরের আকাশকে বলেন, আমার কাছ থেকে ৩ ধাপে নানা অজুহাতে ১৬ হাজার টাকা নিয়েছেন এই তান্ত্রিক। ১ ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে এসে দেবেন। প্রথমে টাকা পাঠানোর পর তৈরি হয় আর একটি সমস্যা, আবারো পাঠানো হয় টাকা। এভাবে তিনবারে ১৬ হাজার টাকা পাঠানো হয়। এরপর থেকে গুরুকে ফোন করলে আর ধরে না। এমনকি ইমুতেও না। রাত ৮টার পর ফোন করতে বলেন ভিডিও কলে। কল দিলে শুধু সাদা কাপড় দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় ভয়ংকর শব্দ শোনায়, আর আসতে আসতে কথা বলেন। ঘড়ের মধ্যে দেখা যায় মানুষের মাথার কঙ্কাল।


সম্প্রতি এমন একটি ঘটনায় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর বলেন, পুরুষ ও নারী ভিক্টিমদের প্রতারণার জন্য তারা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকে। পুরুষদের ধনসম্পদ আর নারীদের স্বর্ণালঙ্কারের লোভ দেখানো হয়। প্রাথমিকভাবে তারা মধ্যরাতে ভিক্টিমদের ফোন দিয়ে এতিমদের খাওয়ানোর নামে দেড় থেকে ৩ হাজার টাকা নেন। এরপর ধীরে ধীরে মোটা অংকের টাকা চান। এদের ফাঁদে না পড়তে সচেতন করে তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনা কারো সঙ্গে ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে নিকট থানায় জানানোর অনুরোধ করেন।