শীতের রুক্ষতা কেটে গাছে গাছে নতুন পাতার ঝলকানি। বাতাসে ফুলের ঘ্রাণ এবং পাখির গান জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে। একই সঙ্গে দুয়ারে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে ভালোবাসা দিবস। আর এর পরেই রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি।
মূলত ঋতুরাজ বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে রাঙাতে প্রধান অনুষঙ্গ রঙ-বেরঙের ফুল। সব আবেদন, অনুরাগ, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার বহির্প্রকাশের বড় মাধ্যম এই ফুল।
নিজেকে সাজাতে বা প্রিয়জনকে উপহার দিতে এই দিনে ফুলের ব্যাপক চাহিদা থাকে। সুবাস ও স্নিগ্ধতায় প্রিয়জনকে আরও কাছে টানে রঙিন ফুল।
এই দিনগুলো ঘিরে প্রতিবছরই বিশেষ যত্নে গাছে গাছে ফুল ফোটান বাগানিরা। রাজধানীর অদূরে সাভারের বিরুলিয়া অনেক আগেই পরিচিতি পেয়েছে ‘গোলাপ গ্রাম’ হিসেবে। কিন্তু এ বছর সেই গোলাপের রাজ্যে হানা দিয়েছে অচেনা শত্রু। পচে গেছে অধিকাংশ গোলাপের কলি। তাই লোকসানের মুখ দেখছে সাভারের ১০টি গ্রামের হাজারেরও বেশি চাষি। করোনার দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া তো দূরের কথা, এবার উৎপাদন খরচ তোলা নিয়েই শঙ্কায় আছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে, সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের শ্যামপুর, মৈস্তাপাড়া, সাদুল্লাপুর, বাগ্নীবাড়ি, ভবানীপুর ও বিরুলিয়াসহ অন্তত দশটি গ্রাম গোলাপ চাষের জন্য বিখ্যাত। এই গ্রামগুলো মানুষের কাছে গোলাপ গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এসব এলাকায় প্রায় ২৭৫ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়। অন্তত ১৫শ কৃষক বাণিজ্যিকভাবে গোলাপের চাষ করেন। কিন্তু এবার গোলাপ গ্রামের হাজারো চাষির বাগান ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে।
সরেজমিনে বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাগানে ফুটে নেই কোনো গোলাপ। গাছের পাতা ও কলির পাপড়ি কালো হয়ে মুষড়ে রয়েছে। কোথাও কোথাও গাছের পুরো অংশই কালো হয়ে গেছে। এতকিছুর পরও কেউ কেউ বাগান পরিষ্কার করছেন। এ ছাড়া দর্শনার্থীরাও দেখতে আসছেন গোলাপের বাগান।
স্থানীয় ফুলচাষি মনির হোসেন জানান, প্রতিবছরের মতো এবারও ঋণ নিয়ে ৬০ শতাংশ জমিতে গোলাপের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু তার সব বাগানেই কোনো ফুলের দেখা পাননি। এক মাস ধরে বাগানের এমন করুণ পরিস্থিতিতে নির্বাক মনির হোসেন।
তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালে একবার এমন হয়েছিল। এলাকার সবার বাগানে অজানা রোগে গাছ আর ফুল মরে শুকিয়ে গিয়েছিল। তখন অনেক গাছ নষ্ট হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনার পর ঋণ করে আবার বাগান করেছিলেন তিনি। এই বছর বাগানে আবারো ওই রকম মড়ক দেখা দিয়েছে।
আক্ষেপ করে মনির হোসেন বলেন, ‘এখন ফুলের মৌসুম। অথচ বাগান থেকে কোনো ফুল বিক্রি করতে পারছি না। অন্যান্য বছর এই সময় প্রতিদিন একটা বাগান থেকেই ২৫০০-৩০০০ ফুল কেটেছি। আর এখন গড়ে প্রতিদিন ১০০ ফুলও পাই না। এখন ঋণের টাকা কিভাবে শোধ করব, সে ভাবনাতেই দিন পার করছি।’
স্থানীয় রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৭৫ শতাংশ জমিতে গোলাপের চাষ করি। তবে করোনার লোকসান কাটিয়ে না উঠতেই আমার বাগানগুলো ছত্রাকের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাগানের গোলাপ গাছ, ডগা, কলি মরে ঝরে পড়ছে। ছত্রাকনাশক ও বাগান পরিচর্যা করেও কাজ হচ্ছে না। বাগান পরিচর্যা বাবদ এখন পর্যন্ত ১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু এক টাকারও ফুল বিক্রি করতে পারিনি।’
এদিকে স্থানীয় বাগানে ফুল না থাকার প্রভাব পড়েছে সাভারের ফুলের দোকানগুলোতে। ভালোবাসা দিবসের দুইদিন আগেই তাদের ২০-৩০ টাকা পাইকারি দরে যশোর থেকে গোলাপ কিনতে হচ্ছে। এত দামে গোলাপ কিনে আরও লাভে বিক্রি করা যাবে কিনা তা নিয়ে বেশ শঙ্কাও আছে।
নবীনগর এলাকার ফুল ব্যবসায়ী ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘সাভার ও যশোর থেকে আমাদের এখানে গোলাপ ফুল আসত। কিন্তু সাভারের বাগান থেকে অনেক দিন ধরে সেভাবে ফুল আসছে না। এ কারণে চাহিদা বেশি থাকায় ফুলের বাজার চড়া।’
এ বিষয়ে সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহমেদ জানান, গোলাপ একমেয়াদি চাষ, কিন্তু সাভারের গোলাপ বাগানগুলোর বয়স অনেক। এখানে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সি বাগানও রয়েছে। প্রতি বছর অতিরিক্ত সার প্রয়োগের কারণে মাটিতে পিএইচের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে গাছ মাটি থেকে আর খাবার সংগ্রহ করতে পারছে না।
এ ছাড়া অসময়ের বৃষ্টি, কুয়াশাসহ অতিরিক্ত শীতকেও দায়ী করে তিনি জানান, বর্তমান আবহাওয়া ফসল উৎপাদনের অনুক‚ল নয়। ফলে কচি পাতা এবং ফুল ঝরে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মাত্রায় পানি প্রয়োগও এ ধরনের সমস্যার কারণ।’
এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা কৃষকদের অতিরিক্ত পানি, সার প্রয়োগ করতে নিষেধ করেছি। মাটির পিএইচ বাড়ানোর জন্য কিছু চুনজাতীয় ডলোমাইট ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি। গোলাপের জন্য যে পরিমাণ পিএইচ দরকার, সেটা এর মাধ্যমে মাটিতে আনা সম্ভব। কিন্তু ওখানকার কৃষকরা আমাদের কথা শুনছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমাদের ঢাকা বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কৃষি কর্মকর্তারাও গোলাপ গ্রাম পরিদর্শন করেছেন। তাদের পরামর্শে রোগ নির্ণয়ে আক্রান্ত গোলাপ গাছ ও ফুলের নমুনা ?কৃষিবিজ্ঞানীদের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। আমরা গোলাপচাষিদের পাশে আছি। উপজেলা প্রশাসনের তহবিল ও সরকারি তহবিল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত গোলাপচাষিদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।’