logo
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:০৭
জারি, পালা ও যাত্রার একাল-সেকাল
পলাশ রায়, ঝালকাঠি

জারি, পালা ও যাত্রার একাল-সেকাল

দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠি। এর চারদিকে বয়ে গেছে শান্ত নদী সুগন্ধা, বিশখালি, বাসন্ডা, হলতা ও ধানসিঁড়ি। এসব নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ শুনতে শুনতেই ঝালকাঠির মানুষজন ‘কবি হয়ে জন্মায়’' স্থানীয়ভাবে এমন কথা প্রচলিত রয়েছে। এ কথার যৌক্তিকতাও রয়েছে। কারণ এখানেই জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন গুণী ব্যক্তিত্ব।


ঐতিহাসিকভাবেই উৎসবপ্রিয় ঝালকাঠির মানুষ। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই বেড়ে ওঠেন তারা। যদিও আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে পুরানো দিনের হারানো ঐতিহ্যের জাবর কাটামাত্র।


অবিভক্ত বাংলায় যাত্রাপালার পথপ্রদর্শক হিসেবে ধরা হয় শশীভূষণ নট্টকে। যার যাত্রাপালা নাট্য কোম্পানির যাত্রা ভারতবর্ষের দুই বাংলায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের পাঞ্জিপুঁথিপাড়া গ্রামের নট্টবাড়ির কৃতী সন্তান তিনি। কেবল তিনিই নন' সংগীত, যাত্রা ও পালাগানে এ বাড়ির আরো অনেকে সুনাম কুড়িয়েছেন।


নদীমাতৃক এ জেলায় জন্মেছিলেন জারি সম্রাটখ্যাত আব্দুল গণি বয়াতি, কালাকেষ্ট, হয়লা ও পালা গানের সম্রাজ্ঞীখ্যাত আয়লা বিবিসহ অনেক গুণীজন। এ জেলার লোককাহিনি নিয়েই বিখ্যাত গুনাই বিবি ও আসমান সিংহের পালার মতো অসংখ্য পালাগান দেশব্যাপী দর্শক-শ্রোতার কাছে ছিল প্রথম পছন্দ। আর হারানো সেই সব দিনে ঝালকাঠির শহর কিংবা গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা, জারি, সারি, হয়লা, রয়-আনি, কবিগান ও পালা গানসহ মাটি ও মানুষের প্রাণের সংস্কৃতিতে মুখরিত ছিল। কিন্তু আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসন আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ হারাতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী যাত্রাপালা, জারি-সারি, পালা ও কবি গানসহ প্রাচীন সংস্কৃতি। ফলে এ শিল্পে জড়িতদের জীবনজীবিকায় যেমন নেমে এসেছে দুর্দিন, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন এসব ঐতিহ্য।


ঝালকাঠি শহরের প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনোয়ার হোসেন খান। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাদের ছেলেবেলায় ঘরে ঘরে হারমনির শব্দে পাড়ায় পাড়ায় সন্ধ্যা নামত। আর এখন গভীর রাতেও ছেলেমেয়েরা বিকট শব্দে সাউন্ড বক্স বাজায়। তা কানে ঢোকে কিন্তু মনের মধ্যে স্পর্শ করে না।’


ষাটোর্ধ্ব এই ব্যক্তি নাটক, যাত্রাপালাসহ ঝালকাঠির অনেক গৌরবের অতীত সংস্কৃতির সাক্ষী। এখনো সময় পেলেই কবিতা ও গান লেখেন, নাটক যাত্রায় অংশ নেন। ঝালকাঠির সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের মহোদীপুর গ্রামে জন্মেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আমলের জারি সম্রাটখ্যাত আব্দুল গণি বয়াতি। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবিও। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ইংরেজিতে গান রচনা করে এবং তা তাৎক্ষণিকভাবে গেয়ে আইয়ুব খানকেও অবাক করেছিলেন এই গুণী মানুষটি। কয়েক হাজার জারি গান লিখে ও নিজের দল নিয়ে সারাদেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি।


ঝালকাঠিতে বয়াতিবাড়িতে চার পুরুষ এই সংগীতসাধনা এখনো ধরে রেখেছেন। গণি বয়াতির মেজ ছেলে আব্দুল হক বয়াতি বাবার পেশা আঁকড়ে জীবিকা চলিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখন সমাজ আধুনিক হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানারকম অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। কিন্তু জারিশিল্পীদের সেখানে স্থান হয় না। অনাদরে আমার পাইলদারদের (সহযোগী) অনেকেই পেশা ছেড়েছেন।’


ঝালকাঠির সদর উপজেলার বারুহার গ্রামের সোহরাব বাউল। বাবার পাইলদার থেকে শুরু হওয়া এ শিল্পী এখনো পেশা ছাড়তে পারেননি। হাটে হাটে ক্যানভাস করে ভেষজ ওষুধ বেচে সংসার চলে তার। আর গ্রামীণ উৎসব আয়োজনে নিজের লেখা গান গেয়ে নিজের মনের খোরাক পূরণ করেন। বরিশাল বেতারেও নিয়মিত গেয়ে যাচ্ছেন এই শিল্পী।


বাউল সোহবার বলেন, ‘আঞ্চলিক ভাষায় সংসারের সুখ-দুঃখ, দেহতত্ত¡ কিংবা ভাব-ভালোবাসার কথা নিয়ে দেশি বাদ্যযন্ত্রে নিজের লেখা গান গাই। কিন্তু আজকালকার ছেলেমেয়ে, এমনকি যুবসমাজও আমাদের গান পছন্দ করে না। গ্রামবাংলার এসব গান-বাজনা অনেকটা অবহেলার চোখেই সবাই দেখে।’


এ নিয়ে কথা হয় ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জেলার গুণী শিল্পীদের সংবর্ধনাসহ বিভিন্নভাবে সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজন করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। আর ঝালকাঠির যাত্রাপালা ও জারি গানকে টিকিয়ে রাখতে নেওয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ।’