logo
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১৩:০১
ঐতিহ্যের প্রতীক চিনি মসজিদ
শরিফুল ইসলাম, নীলফামারী 

ঐতিহ্যের প্রতীক চিনি মসজিদ

এদেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে হাজারো পীর-আউলিয়ার আগমন ঘটেছিল। আর বিভিন্ন সময় মুসলমান শাসকরা ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ স্থাপন করেছিল এই উপমহাদেশে।


এমনই একটি নিদর্শন নীলফামারীর সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ। দেশের ঐতিহাসিক প্রত্মতাত্ত্বিক এবং প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে যে কয়টি মসজিদ রয়েছে, চিনি মসজিদ তার মধ্যে অন্যতম। এটি শুধু উপসনালয় নয়, এই মসজিদ অতীত ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীকও। চিনি মসজিদের নির্মাণশৈলী ও সৌন্দর্য খুব সহজেই সবার নজর কাড়ে। শৈল্পিক কারুকাজ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য হিসেবে চিনি মসজিদের রয়েছে বিশেষ খ্যাতি। তাই এই চিনি মসজিদটি একনজর দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রায় প্রতিদিন এখানে আসেন।


নীলফামারী জেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর শহরের পাশে এটি অবস্থিত। প্রতি শুক্রবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ মসজিদে আসেন জুমার নামাজ আদায় করতে। অনেকেই থেকেও যান দুই-চারদিনের জন্য। এক নজর দেখতে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও আসেন এই ঐতিহাসিক চিনি মসজিদে।


চিনি মসজিদ নির্মাণের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস বেশ সুদীর্ঘ। ১৮৮৩ সালে হাজী বাকের আলী ও হাজী মুকু নামে দুই ব্যক্তি সৈয়দপুরের ইসলামবাগ এলাকায় ছন ও বাঁশ দিয়ে প্রথম এই মসজিদ নির্মাণ করেন। স্থানীয়দের সহযোগিতায় এটি টিনে রূপান্তরিত হয়। এরপর তারা একটি তহবিল গঠন করেন। শুরু হয় মসজিদের নির্মাণ কাজ।


জনশ্রæতি আছে, শঙ্কু নামের জনৈক হিন্দু মিস্ত্রি দৈনিক ১০ আনা মজুরিতে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। স্থানীয় এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে থাকে। এতে ব্যয় হয় ৯ হাজার ৯৯৯ রুপিয়া ১০ আনা। ঐতিহাসিক এই মসজিদের স্থপতি হিসেবে মো. মখতুল এবং নবী বক্সের নাম শোনা গেছে।


মসজিদের সৌন্দর্য বাড়াতে মসজিদের দেয়ালে চিনামাটির থালার ভগ্নাংশ ও কাচের ভগ্নাংশ বসানো হয়। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘চিনি করা’ বা ‘চিনি দানার কাজ করা’। ধারণা করা হয়, এখান থেকেই এর নামকরণ হয় চিনি মসজিদ। আবার কেউ কেউ বলেন, পুরো মসজিদটিতে চিনা মাটির কাজ করা রয়েছে বলে একে চিনা মসজিদও বলা হতো। পরে কালক্রমে চিনা মসজিদ থেকে এর নাম হয় চিনি মসজিদ।


১৯২০ সালে হাজী হাফিজ আবদুল করিমের উদ্যোগে ৩৯ ফুট বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট মসজিদটির প্রথম অংশ পাকা করা হয়। হাজী আবদুল করিম নিজেই মসজিদটির নকশা এঁকেছিলেন। পুনরায় ১৯৬৫ সালে মসজিদের দক্ষিণ দিকে ২৫ বাই ৪০ ফুট আয়তনবিশিষ্ট দ্বিতীয় অংশ পাকা করা হয়। স¤প্রতি এর আয়তন আরও বাড়ানো হয়েছে। ১৯৬৫ সালে বগুড়ার একটি গøাস ফ্যাক্টরি চিনি মসজিদের জন্য প্রায় ২৫ টনের মতো চিনা মাটির পাথর দান করে। এগুলো দিয়ে মোড়ানো হয় মসজিদের মিনারসহ বড় তিনটি গম্বুজ। এর মূল অংশের বর্ণ অনেকটা লালচে হলেও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়। পরবর্তী সময়ে তৈরি করা অংশ অনেকটা সাদা বর্ণের। এ ছাড়া সেই সময় কলকাতা থেকেও ২৪৩ খানা শংকর মর্মর পাথর এনে লাগানো হয় এই মসজিদে।


মসজিদের অনন্য কারুকার্যে সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়। মসজিদের দেয়ালে অঙ্কিত ফুলদানি, ফুলের ঝাড়, গোলাপফুল, একটি বৃত্তে একটি ফুল, চাঁদতারাসহ নানা চিত্র রয়েছে। মসজিদটিতে রয়েছে ২৭টি বড় মিনার, ৩২টি ছোট মিনার ও তিনটি বড় গম্বুজ। মসজিদে একসঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক নামাজ আদায় করতে পারেন। এই মসজিদে রয়েছে উত্তর ও দক্ষিণে দুটি ফটক। মসজিদের গোটা অবয়ব রঙিন চকচকে পাথরে মোড়ানো। আর বারান্দা বাঁধানো সাদা মোজাইকে।


মসজিদের দোতলায় একটি ভবনসহ পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে। সৈয়দপুরের চিনি মসজিদ দেখার জন্য বহু বিদেশি পর্যটকের আগমনের ইতিহাস রয়েছে। স্থাপত্যের নিদর্শন এই চিনি মসজিদ দেশের কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানও পরিদর্শন করে গেছেন। আর নিঃসন্দেহে ‘চিনি মসজিদ’ এ অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করতে রেখেছে অনন্য ভ‚মিকা।