logo
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ২০:৩৬
কিংবদন্তী শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর নেই
ভোরের আকাশ ডেস্ক

কিংবদন্তী শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর নেই

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বাংলা গানের অন্যতম কিংবদন্তী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর নেই। মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ৯০ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পীদের শেষ তারকাও নিভে গেল।

কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

আধুনিক বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীদের মধ্যে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়রা একে একে চলে গিয়েছেন আগেই। এ বার নিভল সন্ধ্যা-প্রদীপও।

গত ২৬ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যা থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবাদ প্রতিম সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা। পর দিন তাকে গ্রিন করিডোর করে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছিল তাঁর। ঘটনাচক্রে তার দু’দিন আগেই কেন্দ্রের পদ্ম সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তিনি।

সঙ্গীতশিল্পীকে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। তড়িঘড়ি গঠিত হয় মেডিক্যাল বোর্ড। জানা যায়, বুধবার রাতে শৌচাগারে পড়ে গিয়ে চোট পান শিল্পী। এর পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছিল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও। তাঁর দু’টি ফুসফুসেই সংক্রমণ দেখা দেয় বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়। চিকিৎসার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ স্থিতিশীল হচ্ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ তাঁর শারীরিক জটিলতা বাড়ে।

বাংলা সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় সন্ধ্যা মুখার্জী নামেও পরিচিত। চলচ্চিত্রের জন্য কণ্ঠ দিয়েই তিনি সবচেয়ে পরিচিতি লাভ করেন।

১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে জন্ম তাঁর। পিতা রেলের কর্মকর্তা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মা হেমপ্রভা দেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট।

পণ্ডিত সন্তোষ কুমার বসু, অধ্যাপক এ টি ক্যানন এবং অধ্যাপক চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে তিনি সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন। তবে তার গুরু ছিলেন উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, তার পুত্র উস্তাদ মুনাওয়ার আলী খান। তাদের অধীনে তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আয়ত্ত করেছিলেন।
সংগীতজ্ঞ মনোরমা শর্মা বলেছেন, ‘নেপথ্য গানের উজ্জ্বল গৌরব অর্জনের পরেও একজন শাস্ত্রীয় গায়ক হিসাবে সন্ধ্যা, তার জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।’

তবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চেয়েও বাংলা গানেই তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন, এর প্রমাণ তার বেশিরভাগ কাজ বাংলা আধুনিক গানে।
১৯৫০ সালে তারানা চলচ্চিত্রে হিন্দি গান গেয়ে মুম্বাইতে তার পদচারণা শুরু হয়। এরপর ১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি তার কলকাতা শহরের বাড়িতে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে তিনি বাঙালী কবি শ্যামল গুপ্তকে বিয়ে করেন। তার গাওয়া অনেক গানের গীতিকবি কবি শ্যামল গুপ্ত।

তবে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি গড়ে ওঠে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের জুটি উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের গানের কণ্ঠের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ই যাক পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও রবিন চট্টোপাধ্যায় ও নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে তিনি অনেক গানে জুটি বেঁধে কণ্ঠ দেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, পশ্চিমবঙ্গে আগত লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনি ভারতীয় বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণ আন্দোলনে যোগ দেন এবং তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশের জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সংগীতশিল্পী সমর দাস। তিনি সহযোগিতা চেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাছে। নিরাশ করেননি সন্ধ্যা। মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি অনেকগুলো গান রেকর্ড করেন।

বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে স্বাধীন দেশে ফিরে আসা উপলক্ষে তার গাওয়া 'বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে' গানটি মুক্তি পায়।

বঙ্গবন্ধুর সরকারও তাঁকে দেন যথাযথ সম্মান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদ্‌যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানের একটি উন্মুক্ত কনসার্টে গান করা বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সন্ধ্যা।

১৯৭১ সালে ভারতীয় 'জয় জয়ন্তী' এবং 'নিশিপদ্ম' ছবিতে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। গান দুটি হল - আমাদের ছুটি ছুটি এবং ওরে সকল সোনা মলিন হল। এছাড়াও ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'বঙ্গবিভূষণ' উপাধিতে সম্মানিত করে।

৯০ বছর বয়সে এসে এবছরের জানুয়ারি মাসে ‘পদ্মশ্রী পুরস্কার’-এর জন্য সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম ঘোষণা করেছিল ভারত সরকার। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ পান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন: গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন সন্ধ্যা