logo
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৪১
দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রগতি
নিখিল মানখিন

দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রগতি

অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের দুর্যোগ মোকাবিলায় অনেকটা এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বা অভিযোজনের প্রস্তুতির দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। আগের চেয়ে হতাহতসহ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকগুণ কমে গেছে। তবে কোনো একটি দেশ বা অঞ্চলের একার পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি নিরসন করা সম্ভব না। জলবায়ু পরিবর্তনে খাপ খাইয়ে চলাটাও কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এটি আন্তর্জাতিক বিষয়।

জলবায়ু পরিবর্তন দিন দিন যেভাবে তীব্র হচ্ছে, তাতে খাপ খাইয়ে চলার প্রস্তুতি দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু নিরাপদ থাকবে তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।


দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির হিসাবে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম। জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা জার্মানওয়াচ থেকে স¤প্রতি এটি প্রকাশিত হয়েছে। ১৮০টি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের তথ্য নিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে।

গত ২০ বছরে দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, ক্ষয়ক্ষতির মোট হিসাব এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে ১৮৫টি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বড় দুর্যোগ আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে শুধু ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অবস্থানে ১৩তম। ২০১৮ সালে অবস্থান ছিল ৮৮তম।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে জার্মানওয়াচ বিশ্বের সব কটি দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও ঝুঁকি নিয়ে ওই সূচকভিত্তিক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে আসছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ক্ষতি, জীবনের ক্ষতি ও দুর্যোগের আঘাতের মোট সংখ্যাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান কিছুটা এগিয়েছে।

যে বছর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়, তার আগের ২০ বছরে ওই দেশটিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের আঘাত ও প্রভাব আমলে নেওয়া হয়। প্রথম তিন বছর বাংলাদেশের নাম শীর্ষে থাকার অন্যতম কারণ ছিল ১৯৯১ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, ১৯৯৫ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলা আমলে নেওয়া হয়।

বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এ কে এম সাইফুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির একটা সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে যায়। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। ২০২১ সালের কয়েক দফা বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যায়। এর কারণ হচ্ছে- আবহাওয়ার দুটি সিস্টেম সক্রিয় হলে পৃথিবীতে ঝড়-বৃষ্টি বেড়ে যায়। এর একটি হচ্ছে ‘এল-নিনো বা লা-নিনো’, আরেকটি হচ্ছে ‘ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ (এমজেও)।

সম্প্রতি বুয়েটের ছয় গবেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের বন্যার ওপর একটি গবেষণা করেছেন। এতে নেতৃত্ব দেন বুয়েটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বিশ্বে তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এ কারণে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ও বেড়ে গেছে।

এ অবস্থায় যদি প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করা যায় এবং এই শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেলে বন্যা কী পরিমাণ বাড়বে, সেটা নিয়ে তারা গবেষণা করেছেন।

বেড়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং ২০২০ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আমফান। গত বছরে একের পর এক বন্যায় দিশেহারা হয়ে পড়ে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। এভাবে ২০১৯ সালে এক বছরেই বুলবুল এবং ফণী নামে দুটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। ছিল তীব্র দাবদাহ। রেকর্ড শৈত্যপ্রবাহের ঘটনাও গত বছর ঘটেছে।

২০১৮ সালে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় তিতলি। ওই বছর আকস্মিক বন্যায় ভেসে যায় পূর্বাঞ্চল। ছিল বজ্রপাতের প্রকোপ এবং কালবৈশাখীর ছোবল। এছাড়া অস্বাভাবিক তাপ ও শৈত্যপ্রবাহ তো ছিলই। ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ সৃষ্টি হয় বঙ্গোপসাগরে। সিলেট অঞ্চলে দুটি বন্যা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার কারণে উত্তরাঞ্চলে একই বছর বন্যা হয়। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত হানে। এর আগে ‘মহাসেন’, ‘আইলা’, ‘সিডর’ হয়ে গেল।

২০০৭ সালের পর মাত্র ১০ বছরে ৫-৭টি ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেল। অথচ এর আগে ১৯৯৮ সালে এবং তার আগে ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় হয়। অপরদিকে পাহাড় ধস ঘটানোর মতো বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বজ্রপাত বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

বেড়েছে তাপমাত্রা

বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণে সেই পরিচিতি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৪ সালে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল।

একই বছর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও ৪০ ডিগ্রিতে উঠেছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে রেকর্ড ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হয়েছিল।

জাতিসংঘের প্যানেল প্রতিবেদন

জাতিসংঘের আন্তঃসরকার জলবায়ু পরির্বতন-সংক্রান্ত প্যানেলের পানিসম্পদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ সমুদ্রতীরের বেশ কটি দেশে সামনের দিনে মিঠা পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তন্মধ্যে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং ভূমিধসের মাত্রা বৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য। আগে ১৫ কিংবা ২০ বছর পরপর বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বর্তমানে ২ থেকে ৩ বছর পরপরই বড় ধরনের দুর্যোগ হানা দিচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত ঝুঁকিতে

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের জন্য যেখানে ছিল যথাযোগ্য তাপমাত্রা, ছিল ছয়টি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ঋতু, সেখানে দিনে দিনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতু হারিয়ে যেতে বসেছে এবং তার সাথে সাথে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আসছে।

ফলে অনিয়মিত, অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত, সেচের পানির অপর্যাপ্ততা, উপকূলীয় অঞ্চলে বর্ষা মৌসুম ছাড়াও বিভিন্ন সময় উপকূলীয় বন্যা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে লবণাক্ত পানিতে জমি ডুবে যাওয়া এবং শুষ্ক মৌসুমে মাটির নিচের লবণাক্ত পানি উপরের দিকে বা পাশের দিকে প্রবাহিত হওয়ার মতো নানাবিধ সমস্যায় বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ চরম হুমকির মুখে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আতিক রহমান বলেন, দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কতগুলো প্রভাব এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। গত বছর চার মাস ধরে চারটি বড় ধরনের বন্যা হয়েছে। ওই বছরই ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ হয়েছে। এরপরই আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘নিসর্গ’। এত কম সময়ের ব্যবধানে ঘূর্ণিঝড় আগে হয়নি। আগে প্রতি ১০ বছরে একটি বড় ঘূর্ণিঝড় হতো। এখন প্রতি দু-তিন বছরে বড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া তাপমাত্রা ও ঋতুভিত্তিক পরিবর্তনও চোখে পড়ছে। অনিয়মিত বৃষ্টি হচ্ছে। যখন হওয়ার কথা তখন হচ্ছে না।