logo
আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:০৪
ন্যায়বিচারের অভিমুখে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা

ন্যায়বিচারের অভিমুখে
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলা

ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে এর (আইসিজে) বিচার কক্ষ

আসছে ২১ ফেব্রুয়ারি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) আবারো শুরু হচ্ছে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানি। এর মধ্যদিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালানোর দায়ে বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে ইিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টার।


মানিবাধিকার সংস্থাগুলো এই মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি ও ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে ফের সেনা অভ্যুত্থানের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি হেগে অবস্থিত আইসিজে আদালতে আগামী ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। মিয়ানমার বাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান চালিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে যার মধ্যদিয়ে তারা কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনেসাইড (গণহত্যা রোধ ও শাস্তিসংক্রান্ত কনভেনশন) লংঘন করেছে। এটা সংক্ষেপে জেনেসাইড কনভেনশন নামে পরিচিত।


হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সহযোগী আন্তর্জাতিক বিচার পরিচালক নুসিন সারকারাইতি বলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর সহিংসতা ও দায়মুক্তির বিরুদ্ধে হওয়া ঐতিহাসিক এই মামলার আসন্ন শুনানির মধ্যদিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ শুরু হচ্ছে। এই মামলা শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, এটা সব দেশের সব মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের পথ খুলে দেবে।


২০১৯ সালের নভেম্বরে গাম্বিয়া মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আইসিজেতে এই মামলা করে। এতে অভিযোগ করা হয়, মিয়ানমার বাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্নভাবে জেনেভা কনভেনশনের বিধান লংঘন করেছে। যদিও আইসিজেতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরাসরি ফৌজদারি মামলা করা যায় না। তবে এটি গণহত্যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার একটি আইনি পন্থা।


২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আইসিজেতে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। সে সময় গাম্বিয়া রাখাইনের অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের গণহত্যার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করতে অস্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইসিজের প্রতি অনুরোধ জানায়। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতে সর্বসম্মতভাবে তাদের সেই অনুরোধ গৃহীত হয়। আসন্ন শুনানিতে মামলা নিয়ে মিয়ানমারের করা প্রাথমিক আপত্তিগুলোর নিষ্পত্তি করা হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুটি অভ্যন্তরীণ বিষয় দাবি করে মিয়ানমার বলেছিল এ নিয়ে মামলা করার এখতিয়ার গাম্বিয়ার নেই এবং আইসিজের বিচারকাজকেও তারা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। তবে সেসব আপত্তি আদালতে টেকেনি। উল্টো অস্থায়ী পদক্ষেপ হিসেবে আইসিজে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব গণহত্যামূলক কর্মকণ্ডের বন্ধের নির্দেশ দেয়। নিরাপত্তাবাহিনী আর গণহত্যা ঘটাবে না এমন নিশ্চয়তা দিতে এবং এ ধরনের সব কর্মকাণ্ডের প্রমাণ সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে মিয়ানমারকে নির্দেশ দেন আদালত। আইসিজের এই নির্দেশ লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

তারা বলছে, রাখাইনে অবশিষ্ট ৬ লাখ রোহিঙ্গা প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে’ এমন প্রমাণ তাদের কাছে রয়েছে।


২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে ফের সেনাঅভ্যুত্থান হয়। এরপর থেকেই সেনাবাহিনী গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে যাচ্ছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী এ পর্যন্ত দেড় হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে অন্তত ১০০ শিশু রয়েছে। এছাড়া জান্তাবিরোধী আন্দোলন করায় ১১ হাজারেরও বেশি মানুষকে আটক করেছে। এরমধ্য রয়েছে রাজানীতিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিক কর্মী। রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে জান্তা সরকার। এছাড়া কোনো রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্য ছেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হচ্ছে। এটাকে নিপীড়ন, বর্ণবৈষম্য এবং স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।


২০১৯ সালে আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন, দেশটির তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের সময় সুচিকে আটক করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে তিনি জেলে রয়েছেন। জান্তা নিয়ন্ত্রিত আদালত সুচিকে ৬ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সুচির বিরুদ্ধে জান্তা সরকার বেশকিছু ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে। বর্তমানে এসবের বিচারকাজ চলছে। এসব অভিযোগে সুচির ১৫০ বছরেরও বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।


২০২১ সালের ২৪ জুন জান্তা সরকার জানায়, সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ৮ সদস্যদের প্রতিনিধিদল আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে উপস্থিত থাকবে। তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গাম্বিয়া গণহত্যার যে অভিযোগ এনেছে তা নিয়ে আইসিজের বিচার করার এখতিয়ার আছে কিনা সে বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন। এবারের শুনানি দোআশঁলা পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ- আদালতে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে বা ভার্চুয়ালি এতে অংশ নেওয়া যাবে। শুনানি আদালতের ওয়েবসাইট এবং ইরেজি ও ফরাসি ভাষায় ইউএন ওয়েব টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।


সেনাবাহিনী গত এক বছর ধরে মিয়ানমারে হত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আইসিজেতে শুধু রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। দেশটিতে সর্বশেষ অভ্যুত্থানের পর নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীগুলো ন্যায়বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। গত এক বছর ধরে বেসামরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা রোহিঙ্গা ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে তাদের ওপরও চলতে পারে এই আশঙ্কা করছে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীগুলো। মামলাটি আইসিজেতে শুনানির ফলে মিয়ানমারের সেনাবহিনীর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আরো বিস্তৃতভাবে উঠে আসতে পারে বলে মনে করেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।


গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট আকিলা রাধাকৃষ্ণন বলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যদি জান্তাবিরোধী আন্দোলনকারী ও ক্ষুদ্র নৃতাত্তি¡ক গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে দমন-নিপীড়ন অব্যাহত রাখে তাহলে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। সেনাবাহিনীর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মকাÐ নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। আইসিজেতে শুনানির ফলে মিয়ানমারের জবাবদিহির ক্ষেত্র তৈরি করবে। এতে শুধু রোহিঙ্গা নয়, সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত বেসামরিক এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজনের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম হবে।


উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টের শেষের দিকে মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংস হামলা চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হয়, ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য নারী। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের হাত তকে রক্ষা পায়নি শিশুরাও। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। রোহিঙ্গাদের ওপর এ ধরনের নির্যাতনকে জাতিসংঘ জাতিগত নিধন হিসেবে বর্ণনা করেছে।


মোমেনা আক্তার পপি; হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইট অবলম্বনে।