একসময় কল্যাণপুর ‘খ’ খালটি ‘রিটেনশন পন্ড’ (ধরে রাখার পুকুর) হিসেবে ব্যবহার করা হতো। দীর্ঘ সময় এই খালটি ছিল ওয়াসার নিয়ন্ত্রণে। ২০২০ সালে খালটি সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। তারপর খালটি উদ্ধারে পরিকল্পনা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালের ১৭৩ একর জায়গার মধ্যে ১৭০ একরই দখলে গেছে। অধিগ্রহণ করা ভূমি ও খাল পুরোটাই কার্যত অস্তিত্বহীন। নামেমাত্র কিছু অংশে ডোবা রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরাই এই খালের মূল দখলদার। সব মিলিয়ে এই খালে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক অবৈধ দখলদার রয়েছে। নির্মাণ হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, গতকাল বুধবার থেকে দখল হয়ে যাওয়া খালটির সীমানা পিলার বসানো শুরু হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে পিলার বসানোর কাজ। এরপরই উচ্ছেদ অভিযান। রামচন্দ্রপুরসহ অন্য দখল হওয়া খালগুলো যে প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা হয়েছে একই প্রক্রিয়ায় কল্যাণপুর-খ খালটিও উদ্ধার করা হবে। আর তিন ধাপে হবে সব খালের কার্যক্রম।
রাজধানীকে একটি বাসযোগ্য ও দৃষ্টিনন্দন শহর হিসেবে গড়তে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উভয় সিটি করপোরেশন খাল উদ্ধার প্রকল্প হাতে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে খাল উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে ২৬টি খালকে আগের চেহারায় ফিরিয়ে আনতে চায় সরকার। পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন খালের ৪২টি স্পটে খনন করবে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সার্বিক তত্ত্বাবধানে খালগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৭৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে খালগুলো থেকে প্রায় ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করেছে সংস্থাটি। বাকিগুলোর কাজ চলমান।
সূত্র জানিয়েছে, খাল দখলমুক্ত করা ও সীমানা নির্ধারণ করে সৌন্দর্য বর্ধনে তিন ধাপে কাজ করবে ডিএনসিসি। সেক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি, মধ্য মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রথম ধাপে খাল দখলমুক্ত করে বর্জ্য অপসারণ করে পানির প্রবাহ ফেরানো হবে। এরপর খালের পাড়ে গাছ লাগানো, ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেনের কাজ দুই ধাপের মাধ্যমে করবে সংস্থাটি।
কাগজে-কলমে ডিএনসিসি এলাকায় ২৬টি খাল রয়েছে। এইগুলোর দুই পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করা এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালের জায়গাগুলো উন্মুক্ত করতে প্রথমে কাজ করছে ডিএনসিসি।
গাবতলী থেকে বেড়িবাঁধ দিয়ে রায়েরবাজারের দিকে এগোতেই পূর্বদিকে একটি পাম্পস্টেশন। প্রবেশপথেই শ্বেতপাথরের ফলক। তাতে লেখা ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দি ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ সিস্টেম ইন ঢাকা সিটি (ফেস-২)। বাংলাদেশ সরকার ও জাপান সরকারের পারস্পরিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ জাপানের জনগণের অনুদান ২০০৯।’
ওই সময় কেবল সেখানে একটি পাম্প স্থাপন করা হয়। সেই পাম্প দিয়ে কিছু পানি শোধন করে তুরাগে ফেলা হয়, যা খুবই নগণ্য। ফলে বর্ষা মৌসুম এলেই আশপাশে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। গত ১২ বছরে ঢাকা ওয়াসা কোনো কাজই করেনি।
‘রিটেনশন পন্ড’ বা ধরে রাখার পুকুর হিসেবে এই ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। গাবতলী এলাকার নিম্নভূমিতে এই প্রকল্প ছিল। গাবতলী বেড়িবাঁধে ওয়াসার যে পাম্পটি রয়েছে সেটিও এই জলাশয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে তোলা। দখল আর দূষণের কারণে সেই পাম্পটি এখন প্রায় অকেজো। ওয়াসার এই জায়গা ও পাম্প সিটি করপোরেশনের কাছে হন্তান্তর করা হয়েছে।
রাজধানীতে খালের সীমানা নির্ধারণের পর সীমানার ভেতরে থাকা সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম।
রাজধানীর কল্যাণপুর রিটেনশন পন্ড এলাকায় আয়োজিত খাল ও রেগুলেটরি পন্ডের সীমানা নির্ধারণ কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি আরো বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালগুলো হস্তান্তর করার পর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র সেগুলো দখলমুক্ত এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু করেছেন। উচ্ছেদ অভিযান কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক খাল উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীকে একটি বাসযোগ্য ও দৃষ্টিনন্দন শহর হিসেবে গড়তে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উভয় সিটি করপোরেশনের মেয়র নিরলসভাবে কাজ করছেন।
নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কল্যাণপুরের এ স্থানে সরকার ১৭৩ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে ওয়াটার রিটেনশন পন্ড নির্মাণ করার জন্য। কিন্তু তিন একর ছাড়া বাকি জমি দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ করার পর এর ভেতর থাকা সকল স্থাপনা উদ্ধার করে পানির প্রবাহ ঠিক করা হবে।
ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের (খাল ও ড্রেনেজ) দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। এরপর থেকে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে কাজ করছে ডিএনসিসি।
আসন্ন বর্ষার আগে খালের পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে চায় সংস্থাটি। তাই খালের সীমানা পিলার নির্মাণ করার কাজ শুরু হয়েছে। ড্রোনের সাহায্যে সিএস জরিপ ও আরএস জরিপ ধরে খালের সীমানা পিলারের স্থান নির্ধারণ করা হবে। সম্প্রতি মোহম্মাদপুরের বসিলায় লাউতলা খালের জায়গায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে এই খাল খননের কাজ করে ডিএনসিসি।
খাল খনন কার্যক্রম বিষয়ে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, নগরীকে জলজট ও জলাবদ্ধতার কবল থেকে মুক্ত করতে হলে খালগুলো উদ্ধার করতেই হবে। খালগুলোর পানি প্রবাহের সৃষ্টি ও নগরীর প্রত্যেকটি খালই মানচিত্র অনুযায়ী উদ্ধার করা হবে। যারা অবৈধভাবে খালের জায়গা দখল বা খাল ভরাট করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তাদের স্বেচ্ছায় অবৈধ দখল ছেড়ে দিতে হবে। অন্যথায় বিনা নোটিশেই অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ স্থাপনাগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।