নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ব্যক্তিগতভাবে কতটা চিন্তিত ছিলেন, তার প্রমাণ যেমন মেলে নিজেদের পুলিশ বাহিনীর জনৈক সদস্যকে নিজেরাই মেরে সে অপরাধ ভাষা আন্দোলনের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টায়, তেমনি তার আপত্তিকর সাম্প্রদায়িক ও ভাষাবিরোধী বক্তৃতায়।
ঘটনার দিনই মুখ্যমন্ত্রী তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় নিহত পুলিশের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপনের পর বলেন: ‘ভাষার প্রশ্নের আবরণের নিচে যে একটি রাষ্ট্রধ্বংসী কুপ্রয়াস চলিয়া আসিয়াছে তাহা ক্রমশ বাহির হইয়া পড়িতেছে। এমতাবস্থায় আমি সমুদয় পাকিস্তানিকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে প্রদেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করার আহ্বান জানাইতেছি’ (আজাদ, ২ মার্চ ১৯৫২)।
আহমদ রফিকের লেখা ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ বইতে এই ইতিহাস তুলে ধরে বলা হয়েছে সেদিনের ইতিহাস। নারায়ণগঞ্জ প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী ও রাজনীতিক শামসুজ্জোহা বলেন, ‘সত্যই নারায়ণগঞ্জ ছিল আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। সেখান থেকে সেদিন চারশ ছেলেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার চাইতে বড় কথা শারীরিক নির্যাতন।’
প্রসঙ্গত, তিনি নারায়ণগঞ্জের সরকারি ডাক্তারের সাহসিকতার উল্লেখ করে বলেন, ‘ডিআইজি ওবায়দুল্লাহর চাপ সত্ত্বেও তিনি ময়নাতদন্তে মিথ্যা রিপোর্ট দিয়ে ভাষাসংগ্রামীদের সংশ্লিষ্ট করতে রাজি হননি। এমনই ছিল ভাষা আন্দোলনের সুপ্রভাত।’
আমরাও বলি, ঢাকায় যে সংগ্রামের শেষ তার শুরু নতুন করে নারায়ণগঞ্জে মমতাজ বেগমের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে। এবং তা এমনই তীব্র ও ব্যাপক ছিল যে সরকার তা দমন করতে দশ বছর বয়সি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র মোসলেহ উদ্দিনকেও গ্রেপ্তারে দ্বিধা করেনি। তার স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ২১ দিন কারাগারে ছিলেন তিনি (দিশা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)।
শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, দেশের প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরে ভাষা আন্দোলন মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন হিসেবে শিক্ষিত শ্রেণির বাইরে সাধারণ মানুষের চেতনা স্পর্শ করেছিল বলেই দেশব্যাপী আন্দোলন দমন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয়নি। আন্দোলন আপন নিয়মেই একসময় স্তব্ধ হয়ে যায়।
বইতে আরো লেখা হয়েছে, ‘ইতিমধ্যে কোণঠাসা অবস্থায়ই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে ৫ মার্চ ঢাকায় হরতাল ঘোষণা করা হয়। যত দূর মনে পড়ে, তখনো সফলভাবে হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বেশ কিছু পোস্টার সাঁটা হয় শহরের দেয়ালে দেয়ালে। প্রচারও চলে বিভিন্ন এলাকায়। সরকার মরিয়া ওঠে হরতাল ব্যর্থ করার উদ্দেশ্যে’।
ইতিমধ্যে দৈনিক ‘আজাদ’ ভোল পাল্টে কুখ্যাত দৈনিক ‘মর্নিং নিউজ’-এর কায়দায় আন্দোলনের বিরুদ্ধে সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করেছে। ৫ মার্চ হরতালের মাত্র এক দিন আগে (৪ মার্চ) ঢাকাই নবাব খাজা হাবীবুল্লাহর সভাপতিত্বে মহল্লা সরদারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে পাকিস্তান ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আন্দোলনকারীদের সম্বন্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে ‘কম্যুনিস্ট ও বিদেশী চরদের পাকিস্তান ধ্বংস করার প্রয়াসের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়।’ (আজাদ, ৫ মার্চ ১৯৫২)।
এর পেছনে ছিল সরকারের কলকাঠি নাড়া। আর ঢাকার নবাববাড়ি শাসিত মহল্লা সরদারদের প্রভাব পুরান ঢাকায় তখনো ছিল প্রবল। মহল্লা সরদারদের প্রভাবিত করা সম্ভব হয়েছিল নাস্তিক কমিউনিস্ট ও ভারতীয় এজেন্টদের পাকিস্তান ধ্বংসের ভূমিকা সম্বন্ধে মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসন, দু-একটি সংবাদপত্রের লাগাতার প্রচারণার কারণে।
মুখ্যমন্ত্রী তার ৪ মার্চের ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন : ‘রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার জন্য কতিপয় কমিউনিস্ট ও অন্যান্য বিদেশি দালাল এবং অসন্তুষ্ট রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে গভীর ষড়যন্ত্র চলিতেছিল, সরকারি ব্যবস্থার ফলে তাহা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইয়াছে। এভাবে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও লীগ নেতাদের বক্তব্যের জের ধরে কমিউনিস্ট ও বিদেশি এজেন্টদের ওপর আন্দোলন সংঘটনের সব দায় চাপিয়ে দিয়ে তিনি জানালেন, ‘ভাষা-বিতর্ক আসলে নয়,...ভাষা-বির্তকের আওতায় নিগূঢ় দূরভিসন্ধি রহিয়াছে।’