logo
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১০:৫৮
বুড়িগঙ্গা তুমি বইছ কেন?
শাহীন রহমান 

বুড়িগঙ্গা তুমি বইছ কেন?

প্রায় চার শ বছর আগে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে যে শহরটি গড়ে উঠেছিল তা আজ বাংলাদেশের রাজধানী। অথচ যে নদীকে কেন্দ্র করে এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছিল তা দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। রাজধানীর বুকে শীর্ণকায় হয়ে কোনো রকম প্রবাহ ধরে রেখেছে। অথচ এই বুড়িগঙ্গার রয়েছে অনেক ইতিহাস। শত শত বছর ধরে এর রূপ-সৌন্দর্য বহু বিদেশিদেরও মুগ্ধ করেছে। তাই তাদের লেখনীতে বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্যকে ভেনিস শহরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী দূষণ হচ্ছে প্রায় ১৬০ বছর ধরে। গত চার দশকে দূষণের তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশ্বের দূষিত ১০টি নদীর মধ্যে বুড়িগঙ্গার অবস্থান ৬ নম্বরে। প্রশ্ন হলো, কেন বুড়িগঙ্গার এমন মরণদশা। সেই ইতিহাস অনেক পুরোনো। যদিও সম্প্রতি এর দখল এবং দূষণ নিয়েই বেশি আলোচনা হচ্ছে। এর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা বহু কলকারখানার অপরিশোধিত পদার্থ প্রতিনিয়ত নদীকে দূষণ করে চলেছে। দখল হতে হতে এককালের প্রমত্তা এখন শীর্ণকায়।

তবে ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার এই করুণদশার ইতিহাস হাল আমলের নয়। প্রায় ১৬০ বছর ধরেই নদীটি বহু অত্যাচার সহ্য করে বয়ে চলেছে। সেই ব্রিটিশ আমলেও নদীটির দূষণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। দূষণ রোধে করণীয় ঠিক করতে ১৪০ বছর আগে কমিশন গঠন করা হয়েছিল। হাল আমলে এসে ২০০৯ সালে নদী রক্ষা করতে আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। ওই বছর জুন মাসে ঢাকার চার নদী রক্ষায় আদালত যুগান্তকারী রায় প্রদান করেন।

রায়ে বলা হয়, ঢাকার নদীগুলো বাঁচানো না গেলে রাজধানী ঢাকাকে রক্ষা করা যাবে না। একই সঙ্গে নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই থেকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বহু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নদীর দূষণ-দখল রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

বাংলা পিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বুড়িগঙ্গা নদী ঢাকা শহরের দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত জেয়ারভাটা প্রভাবিত একটি নদী। মোগলরা এই নদীটির জোয়ারভাটার রূপ দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিল। নদীটির নামকরণ বুড়িগঙ্গা করার পেছনে সনাতনী কাহিনি রয়েছে। প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীর একটি প্রবাহ ধলেশ্বরীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। ধীরে ধীরে এই প্রবাহটি তার গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে একসময় গঙ্গার সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই বিচ্ছিন্ন প্রবাহটি বুড়িগঙ্গা নামে অভিহিত হয়। মূলত ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল। বর্তমানে উৎসমুখটি ভরাট হওয়ায় পুরোনো কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।

বুড়িগঙ্গাভিত্তিক ঢাকা শহরের বিকাশ যখন থেকে শুরু তখন থেকেই দূষণের ইতিহাসও শুরু। ১৮৬৬ সালে বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশনের রিপোর্টে বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গার মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে।

ফলে বিভিন্ন স্থান থেকে আবর্জনা, গলিত পদার্থ মিশে দূষিত করছে বুড়িগঙ্গা। দ্বিতীয় কারণে বলা হয়, নদীর শ্রোতে গলিত আবর্জনা ভেসে ভেসে তীরবর্তী এলাকায় দূষণ করছে। ১৮৯৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় ‘বুড়িগঙ্গা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকার বাণিজ্যের বিষম অনিষ্ট হইতেছে। ঢাকায় যাহাদের বাড়িঘর প্রভৃতি আছে’।

১৮৬৬ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ক্রমেই বুড়িগঙ্গা অপ্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে পলির কারণে। একটি পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় ‘বুড়িগঙ্গার মুখে চর পড়াতে পূর্ব্বাপক্ষা ইহার জলের স্বল্পতা হইয়াছে এবং তদৃশত: যে যে অসুবিধা ঘটিবার সম্ভাবনা...অতএব বুড়িগঙ্গার গভীরতা ও প্রবাহ প্রবর্ধনে সদুপায় বিধান করিয়া সেই অসুবিধা নিবারণ করা যায়।’ এরও ৪০ বছর আগে ঢাকা নীল ব্যবসায়ী ওয়াইজ বলেছিলেন, ‘বুড়িগঙ্গায় হাঁটুজল থাকে’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী দূষণের শতকরা ৮৮ ভাগ কারণ হলো ঢাকার বর্জ্য নদীতে ফেলা। এ ছাড়া দুই পাড় চলে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের দখলে। শুধু তীর নয়, নদীর মাঝ পর্যন্ত দখল করা হয়েছে। নদীর তীরের দূষণ গত চার দশক ধরে তীব্র হচ্ছে। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বিশ্বের দূষিত নদীর তালিকায়ও এই বুড়িগঙ্গার নাম উঠেছে। বিশ্বের এখন যে ১০ নদী সবচেয়ে বেশি দূষিত, তার মধ্যে বুড়িগঙ্গার অবস্থান ছয় নম্বরে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের এক জরিপে বলা হয়েছে, মাত্র ৪০ ভাগ কারখানা থেকে পানি শোধিত হয়ে নদীতে পড়ছে। বাকি কারখানা থেকে অপরিশোধিত পানি সরাসরি নদীতে পড়াই নদী দূষণের অন্যতম কারণ। এ ছাড়া শিল্পকারখানার ৬০ ভাগ বর্জ্য ছাড়া ওয়াসা ও সিটি করপোরেশনের ৩০ ভাগ বর্জ্য নদীতে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করে কোনো লাভ হচ্ছে না। এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮ দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বাংলাদেশের নদীর পানি।

বুড়িগঙ্গার বর্তমান অবস্থা নিয়ে কম আলোচনা হচ্ছে না। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বাইরে থেকেও বুড়ি নদীর দূষণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রায় সব ধরনের গবেষণায় দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গায় বর্তমানে পানির কোনো অস্তিত্ব নেই। ঢাকার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি বড় মাপের ড্রেন মাত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা প্রতি লিটারে ৪ মিলিলিটারের নিচে নেমে গেলে তা আর পানি হিসেবে ধরা হয় না। বর্ষা মৌসুম বাদে বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা থাকছে প্রায় শূন্যের কোঠায়।

সম্প্রতি বেসরকারি সংগঠন ওয়াটার্স কিপার বাংলাদেশ বুড়িগঙ্গা নদীর গুণগতমান পরীক্ষা করে জানায়, পানির পিএইচ পরিমাপে দেখা যায়, শ্যামপুর ডায়িং ইন্ডাস্ট্রির পানিতে পিএইচের মান প্রাক বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে যথাক্রমে ৭.৬, ৬.৭ এবং ৮.৫। অথচ পানিতে পিএইচের আদর্শমান ৭-এর থেকে বেশি প্রদর্শন করলে তা ক্ষারধর্মী এবং কম প্রদর্শন করলে তা অল্মধর্মী। শ্যামপুরের পানিতে টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস-এর পরিমাণ পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে তিন ঋতুতে যথাক্রমে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। পানিতে টিএসএসের আদর্শ মান ১০।

সুতরাং শ্যামপুরের পানিতে প্রচুর পরিমাণে টিএসএস বা টোটাল সাসপেন্ডেড সলিডস পাওয়া যায় যা পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানির নিচে নদীতলে পাতলা আস্তরণ সৃষ্টি করে যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।

প্রাকবর্ষা, বর্ষা এবং বর্ষা-পরবর্তী সময়ে শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডি এর পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই তিন ঋতুতে সিওডি-এর পরিমাণ যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। যা আদর্শমান ৪ এর চেয়ে বহুগুণে বেশি। জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডির পরিমাণ পরীক্ষা করে দেখা যায়, ওই তিন সময়ে বিওডির পরিমাণ যথাক্রমে ৮৭,৭২, ও ১০৬, যা আদর্শমান ০.২-এর তুলনায় অত্যধিক বেশি। শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় প্রকার অক্সিজেন ডিমান্ড অত্যন্ত বেশি, যা এই পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকাকে নির্দেশ করে।

পানিতে নাইট্রোজেনের অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যায়, তিনটি ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে অ্যাম্যোনিয়ার পরিমাণ ৪.৮, ৪.২, ও ২.৮ যা আদর্শমান ০.৫ এর চেয়ে বহুমাত্রায় বেশি। এই অতিরিক্ত নাইট্রোজেন নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য দূষণীয়।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বর্তমানে পানি এত দূষিদ যে বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ পরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে না। পানির দিকে তাকালেই দেখা যায় এর রং গোলাপি। মানুষের কিডনি রোগ এবং ক্যান্সারের প্রবণতা বেড়ে গেছে এই দূষণের কারণে। বুড়িগঙ্গা আমাদের প্রাণ, বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ, আর তাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।