logo
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ১২:০৬
ইউক্রেন উত্তেজনা
নাটাই এখন পুতিনের হাতে
মোমেনা আক্তার পপি 

নাটাই এখন পুতিনের হাতে

ওলফ সলৎস ও ভ্লাদিমির পুতিন

ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সৈন্য সমাবেশ নিয়ে কয়েক মাস ধরে টানা উত্তেজনা বিরাজ করছে সারা বিশ্বে। সংকট নিরসনে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে নীবিড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা। সব মিলিয়ে ইউক্রেন ইস্যু এখনো সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর সমাধানে হয় যুদ্ধ, না হয় কূটনৈতিক পন্থা’ যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে বিশ্ব নেতাদের। এ নিয়ে পশ্চিমা নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পুতিন ক‚টনৈতিক পন্থাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

সমাধান যে পথেই হোক’ এর জন্য ইউক্রেন এবং ইউরোপের বাকি অংশকে মূল্য দিতে হবে। সংকট যদি যুদ্ধের পথে যায় তাহলে তার ক্ষয়ক্ষতি হবে অকল্পনীয়। এ কারণে ইউরোপের অন্যতম বড় শক্তি ফ্রান্স ও জার্মানি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে অনড় অবস্থানে থাকা পারমাণবিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াকে বুঝিয়ে আলোচনার টেবিলে আনতে। তারা এমন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে চায়’ যাতে ক্রেমলিন খুশি হয় এবং হোয়াইট হাউসও ক্ষুব্ধ না হয়। যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমধান সম্ভব বললেও রাশিয়ার সঙ্গে বৈঠক নিয়ে এখনো দ্বিধান্বিত। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের মতবিরোধের কারণে নাটাই এখন চলে গেছে পুতিনের হাতে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এমন একজন মানুষ, যিনি সবসময় বিকল্প হাতে রাখতে পছন্দ করেন। ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ক্রেমলিন নেতা ইতোমধ্যে সংকেত দিয়েছেন তিনি ক‚টনৈতিক পন্থায় আগ্রহী। গত মঙ্গলবার জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের সঙ্গে বৈঠকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা ডনবাসের কথা উঠে আসে। এই এলাকার কিছু অংশ রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে।

পুতিন জানান, সেখানকার পরিস্থিতি ভালো নয়। সেখানে আজ যা হচ্ছে তাকে এক কথায় গণহত্যা বলা যায়। যদিও শোলৎজ সেসময় পুতিনকে পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভুল করে রুশ নেতার মুখ দিয়ে গণহত্যা শব্দটি বের হয়ে গেছে। তিনি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন। রুশ নেতা তার বক্তব্যের মোড় অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দিলেও ততক্ষণে তার বক্তব্য মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল।

ডনবাসের পরিস্থিতি নিয়ে পুতিনের এই অভিযোগ নতুন কিছু নয়। ইউক্রেনে থাকা রুশ জাতি ও রুশভাষীদের অধিকার লংঘিত হচ্ছে বলে পুতিন বারবার অভিযোগ করেছেন। তাদের সুরক্ষার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাশিয়ার রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। পুতিন তার নিজের স্বার্থেই তাদের রক্ষা করার দায়িত্বের ধোঁয়া তুলেছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে ডনবাসের পরিস্থিতি রুয়ান্ডার মতো নয়। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় ১০০ দিনের অভিযানে আট লাখেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়, যার বেশির ভাগই ছিল তুতসি সম্প্রদায়ের। একই পরিস্থতি হয়েছিল সেব্রেনিকায়ও। ১৯৯৫ সালে সেখানে সাত হাজরেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল মুসলিম পুরুষ ও বালক।

পশ্চিমারা ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে একমত হলেও রাশিয়া সম্পর্কে তাদের মনোভাব এক নয়। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র এখনো নিজ অবস্থান ঠিক করতে পারছে না। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার দিকে ক‚টনীতির হাত বাড়িয়েছে। এটা ঠিক যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের কিছু দেশ ইউক্রেনে হামলা হলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো বেলজিয়ামও ওয়াশিংটনের পথে হাঁটছে না। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক‚টনৈতিক পথে এগোচ্ছে ব্রাসেলস। যুদ্ধের উসকানি এবং মস্কোর রোষানল এড়াতে বিশে^র তৃতীয় ও চতুর্থ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ ফ্রান্স ও জার্মানি ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো থেকে বিরত রয়েছে।

দেশ দুটির এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের মতের বিরুদ্ধে গেছে। কারণ ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বেশ তৎপর। এ ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন তার পূর্বসূরি টনি বেøয়ারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পোষ্যতে পরিণত হয়েছে।

২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের প্রাক্কালে ক‚টনীতিকরা যে চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল তা সেটাকে সামনে রেখে বর্তমানে উভয় পক্ষই মতবিরোধ হ্রাসে খুবই সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলছে। প্যারিস ও বার্লিন ইতোমধ্যে ওয়াশিংটন এবং লন্ডনকে ভুল প্রমাণ করেছে। ইরাক যুদ্ধের ধাক্কা পশ্চিমা বিশে^র ঐক্য, নিরাপত্তা ও বিশ^াসযোগ্যতাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

বাইডেন প্রশাসনের মতে, ইরাক নয়, যে ভুলের পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয় তা হলো জর্জিয়া। রাশিয়ার উসকানিতে ২০০৮ সালে জর্জিয়া যুদ্ধ শুরু হয়। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালে ইউক্রেন পরিস্থিতিও উদাহরণ হতে পারে। সে সময় রাশিয়া অনেকটা বিনাবাধায় ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। শঙ্কার বিষয় হলো, বাইডেন চান না পশ্চিমা বিশ্ব বা ন্যাটো সারাক্ষণ পাহারার কাজ করুক বা পুতিনের ভাবধারা বেঁচে থাকুক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতে, পুতিন হৃদয়হীন মানুষ। তাকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না।

বিপরীতে ইউরোপীয়রা অনেক বেশি বাস্তববাদী। বিশেষ করে জার্মান রাশিয়ার হৃদয় বা আত্মা নিয়ে ভাবে না। তাদের চিন্তা রাশিয়ার গ্যাস এবং পরমাণু কার্যক্রম নিয়ে। রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ইউরোপ ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। রাশিয়ার বাণিজ্যের বৃহত্তম অংশীদার ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যা মোট বাণ্যিজ্যের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

এসব বিবেচনায় ২০০৮ সালে রাশিয়া ও জর্জিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বিরতিতে ফ্রান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি বৈঠকের সুবিধার্থে জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্স ২০১৪ সালে নরম্যান্ডি ফরম্যাট প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটাই অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের (ওএসসিই) কাঠামোর মধ্যে থেকে মিনস্ক চুক্তির পথ সুগম করেছিল।

সে সময় এই চুক্তিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। কারণ এর দ্বারা যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। যদিও অনেকের মতে, রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের হুমকি থেকে বাঁচতে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জর্জিয়া ও ইউক্রেন চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হয়। এ কারণে মিনস্ক চুক্তি নিয়ে মস্কো অনড় অবস্থানে থাকলেও কিয়েভ তা বাস্তবায়নে দ্বিধাগ্রস্ত।

সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ক্রেমলিন ২০১৫ সালের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে' এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডনবাসে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলার অভিযোগ তুলে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ম্যরিউপুল শহরে অন্তত ৩০ জনকে হত্যা করে। মূলত ২০১৪ সালে ডনবাসে সংঘাত শুরু হয়।

জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, সেসময় সেখানে হাজার হাজার বেসামরিক নিহত ও আহত হয়। অভিযোগের সত্যতা যাই হোক না কেন, কোনো সংস্থা সেটা স্বাধীনভাবে তদন্ত করেনি। তবে বর্তমানে ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাতের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সেটা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডনবাসের বিচ্ছন্নতাবাদীদের আইনি মর্যাদার প্রশ্নও এখানে রয়েছে। রাশিয়া কখনোই ডনবাসে স্ব-ঘোষিত দোনেতস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর) এবং লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিককে (এলপিআর) স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। উল্টো সেখানকার মানুষের হাতে রাশিয়ার পাসপোর্ট তুলে দিয়েছে। তবে রুশ আইনপ্রণেতারা চলতি সপ্তাহের শুরুতে ডনবাসের বিচ্ছিন্ন প্রজাতন্ত্রগুলোকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আবেদন জানিয়েছে। হতে পারে এই প্রজাতন্ত্রগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউক্রেনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে রাশিয়া।

ডিএনআর এবং এলএনআরের স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো মিনস্ক চুক্তি থেকে বের হয়ে আসা। আপাত দৃষ্টিতে ইউক্রেন সংকট সামাল দিতে ক্রেমলিনের কাছে এর চেয়ে ভালো কোনো পথ আর নেই। এতে নতুন করে অনেকগুলো সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু আখেরে লাভবান হবে ক্রেমলিন। এটাকে কেন্দ্র করে রাশিয়া তার বিকল্পগুলোর বিস্তার ঘটাবে। সূত্র- সিএনএন ও আলজাজিরা অবলম্বনে।