১৮ বলে দরকার ১৮ রান। রয়ে-সয়ে খেললেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারত বরিশাল। কিন্তু কুমিল্লার বোলারদের তুখোড় নৈপুণ্যে শেষ ওভারে সমীকরণ দাঁড়ায় ১০ রানে। হাতে উইকেট থাকলেও এ হিসাব মেলাতে পারেনি ফরচুন বরিশাল। উত্তেজনায় ঠাসা ফাইনালে শেষ ওভারে বরিশাল তুলতে পারল ৮ রান। ১ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়ে বিপিএলের শিরোপা ঘরে তুলল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। তিনবার ফাইনালে উঠে তিনবারই চ্যাম্পিয়ন দলটি। খুব কাছে এসেও শিরোপা অচ্ছুত থাকল সাকিবের বরিশালের।
গতকাল মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে আগে ব্যাট করতে নেমে কুমিল্লা করে ৯ উইকেটে ১৫১ রান। জবাবে বরিশাল করে ৮ উইকেটে ১৫০ রান। ব্যাট হাতে ঝড় তোলার পর বল হাতেও দারুণ করায় অনুমিতভাবে ম্যাচসেরার পুরস্কার জেতেন কুমিল্লার ক্যারিবীয় অলরাউন্ডার সুনিল নারিন। জয়ের লক্ষ্যে খেলতে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় বরিশাল।
দ্বিতীয় ওভারে শহিদুলের বলে ডু প্লেসিসের হাতে ক্যাচ দেন দারুণ ফর্মে থাকা মুনিম শাহরিয়ার। ৭ বল খেলেও রানের খাতা খুলতে পারেননি বরিশালের এ ওপেনার। দায়িত্ব বর্তায় গেইলের কাঁধে। তবে শুরুর দিকে গেইল নয়, ব্যাট হাতে আগুন ঝরান হুট করে ফাইনালে নামা সৈকত আলী। লিগ পর্বে তিন ম্যাচে কুমিল্লার হয়ে তার রান ছিল যথাক্রমে ৩৯, ১৫, ০। ফাইনালের মঞ্চে যেন খেপে গেলেন তিনি। মুহুর্মুহু বাউন্ডারিতে কাঁপিয়ে তোলেন চার পাশ। বরিশালের রান বাড়তে থাকে তরতরিয়ে।
২৬ বলে ফিফটি পূর্ণ করেন সৈকত। অবশেষে তিনি থামেন ব্যক্তিগত ৫৮ রানে। বরিশালের রান তখন ৭৯। তানভিরের বলে ইমরুল কায়েসের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। ৩১ বলের ইনিংসে তিনি হাঁকান ১১টি চার। ছক্কা একটি। সেখান থেকে লকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন ক্রিস গেইল। সঙ্গে ছিলেন কিপার-ব্যাটার নুরুল হাসান সোহান। এ জুটি লকে নিয়ে যান ১০৭ রান পর্যন্ত।
শুরুতে ধীরগতির হলেও আস্তে আস্তে স্বরূপে ফিরতে চলেছিলেন গেইল। তাতে বাধ সাধেন তারই স্বদেশি নারিন। ১২.৫ ওভারে এলবির ফাঁদে ফেলেন গেইলকে। রিভিউ নিয়েও কাজ হয়নি, ব্যর্থ মনোরথে সাজঘরে ফেরেন গেইল ৩১ বলে ২টি ছক্কা ও ১টি চারে ৩৩ রান করে।
এরপর বড় ভরসার জায়গা সাকিবও হতাশ করেন দলকে। তানভিরের বলে মোস্তাফিজের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন বরিশাল অধিনায়ক। ৭ বলে ১টি চারে তার রান মাত্র ৭। বল ও রানের ব্যবধান তখন খুব সামান্য। কিন্তু দলীয় ১৩৬ রানের মধ্যে আরো দুটি উইকেট পড়ে গেলে চাপে পড়ে বরিশাল। ৬ রানের মধ্যে পড়ে ৩ উইকেট। ১৩ বলে ১৪ রান করে রানআউট নুরুল হাসান। পরের ওভারে ব্রাভোকে (২ বলে ১ রান) এলবির ফাঁদে ফেলেন নারিন। ১২ ওভারে বরিশালের তখন দরকার ১৬ রান। ১৯তম ওভারের দ্বিতীয় বলে শান্তকে এলবিডব্লিউ করেন মোস্তাফিজ। এ ওভারে আসে মাত্র ৬ রান।
শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার পড়ে ৬ বলে ১০ রান। ক্রিজে বরিশালের তখন মুজিব উর রহমান ও তৌহিদ হৃদয়। বল করতে আসেন শহিদুল। স্ট্রাইক প্রান্তে হৃদয়। প্রথম বল ডট। পরেরই বলেই রান। পরেরটি ওয়াইড। শেষ বলে দরকার ছিল ৩ রান। হৃদয় নিতে পারেন মাত্র ১ রান। ২ রান নিতে গিয়ে তিনি হন রানআউট। ১ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়ে চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা। বল হাতে কুমিল্লার হয়ে দারুণ করেন নারিন। ৪ ওভারে ১৫ রানে ২ উইকেট নেন তিনি।
এছাড়া তানভির দুটি, মোস্তাফিজ ও শহিদুল নেন একটি করে উইকেট। এর আগে টস জিতে ব্যাট হাতে শুরুটা উড়ন্ত কুমিল্লার। তার মূল কারিগর সেই নারিন। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার মাচে যার ব্যাটে উঠেছিল ঝড়। করেছিলেন বিপিএলের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। অপর প্রান্তে লিটন দাস অনেকটা নিষ্ক্রিয় থাকলেও নারিন এদিনও ছিলেন মারমুখী। প্রথম থেকে শুরু করেন চার-ছক্কার ফুলঝুরি।
রান উঠছে তরতরিয়ে। এমন অবস্থায় কুমিল্লার উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন বরিশাল অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। বোল্ড করেন দেন লিটনকে (৬ বলে ৪ রান)। জয়কে সঙ্গে নিয়ে নারিনের ঝড়ো ইনিংস তখনো চলছে। আগের দিন ১৩ বলে ফিফটি করা নারিন এদিন ৫০ পূর্ণ করেন ২১ বলে। এর মধ্যে ছিল ৫টি চার ও ৪টি ছক্কার মার। ফিফটির পরপরই নারিনকে ফিরিয়ে বরিশাল শিবিরে স্বস্তি এনে দেন মেহেদী হাসান রানা। কুমিল্লার রান তখন ৬৯। রানার স্লোয়ারে শান্তর হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ক্যারিবীয় এ অলরাউন্ডার। যাওয়ার আগে করে যান ২৩ বলে ৫৭ রানের মারকাটারি ইনিংস। তার ইনিংস সাজানো সমান ৫টি করে চার ও ছক্কায়।
নারিনের বিদায়ের পর কুমিল্লার ব্যাটিং লাইনআপে যেন মড়ক লাগে। লীয় ৯৫ রানের মধ্যে নেই ৬ উইকেট। দলীয় ৭৩ রানে দুর্ভাগ্যজনক রানআউটের শিকার মাহমুদুল হাসান জয় (৭ বলে ৮ রান)। ফাইনালের মঞ্চে জ্বলে উঠতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকার ফাফ ডু প্লেসিস। আফগান স্পিনার মুজিব উর রহমানের বলে তার হাতেই ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ডু প্লেসিস। ৭ বলে তিনি করেন মাত্র ৩ রান। অধিনায়ক ইমরুল কায়েস ফাইনালে থেকেছেন নিষ্প্রভ। ১২ বলে ১২ রানে তিনি ফেরেন সাজঘরে ব্রাভোর বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে। পরের ওভারেই ফেরেন রানের খাতা খুলতে না পারা আরিফুল হক। মুজিবের বলে তিনি হন বোল্ড।
সপ্তম উইকেটে হাল ধরার চেষ্টা করেন ইংলিশ অলরাউন্ডার মঈন আলী ও আবু হায়দার রনি। এ জুটি দলকে ১০০ পার করে। এ জুটিতেই চ্যালেঞ্জিং স্কোরে পৌঁছায় কুমিল্লা। যদিও শেষ ওভারটি কুমিল্লার জন্য হতাশার ছিল। শফিকুল ইসলামের বলে এ ওভারে বিদায় নেয় কুমিল্লার তিন ব্যাটার। রান আসে মাত্র তিন। ২ রান নিতে গিয়ে প্রথম বলে রানআউট হয়ে ফেরেন মঈন। ৩২ বলে ২টি চার ও ১টি ছক্কায় তিনি করেন ৩৮ রান। সপ্তম উইকেট জুটিতে আসে সর্বোচ্ছ ৫৩ রান। তৃতীয় বলে আউট রনি।
শফিকুলের হাতেই ক্যাচ দেন ২৭ বলে একটি করে চার ও ছক্কা হাঁকানো রনি। শহিদুল, তানভির ও মোস্তাফিজ রানের খাতাই খুলতে পারেননি। ৯ উইকেটে কুমিল্লার ইনিংস শেষ হয় ১৫১ রানে। বল হাতে বরিশালের হয়ে মুজিব ও শফিকুল দুটি, সাকিব, ব্রাভো ও রানা নেন একটি করে উইকেট।